আমিনুল ইসলাম মল্লিক
Advertisement
নারী আমার মা নারী আমার বোন, নারী আমার স্ত্রী। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশে অর্ধেক নারী। নয় কোটি, সংখ্যাটি কম নয়। তাদের অধিকার, অবদান ও মর্যাদা কোনোমতেই ভুলে গেলে চলবে না। এসব বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সংবিধান ও তাদেরকে অধিকার দিয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো আমাদের সংবিধানেও নারীর অধিকার নিয়ে স্পষ্ট বলা আছে। সংবিধানের বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদে অত্যন্ত সুনিপুণ ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে নারীর অধিকারগুলো। যা তাদের আপন সত্ত্বাকে উদ্ভাসিত, গৌরবান্বিত ও মহিমান্বিত করেছে।
আমাদের সংবিধান দিয়েছে নারীর অধিকারের প্রতি এক অসাধারণ স্বীকৃতি। সাংবিধানিকভাবে নারী-পুরুষে বৈষম্য করার কোনও সুযোগ নেই। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদে আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী,বর্ণ, নারী-পরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না’। সংবিধানের ২৮ (২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরের নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন’।
সংবিধানের ২৮(৩) অনুচ্ছেদে আছে, ‘কেবল ধর্ম,গোষ্ঠী,বর্ণ,নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না’। সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে,‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না’।
Advertisement
সংবিধানের ২৯ (১) অনুচ্ছেদে আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগের সমতা থাকবে। সংবিধানের ২৯(৩)(ক)অনুচ্ছেদে বলা আছে, নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মী উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধা-প্রণয়ন করা হইতে‘
(খ) কোনো ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপ সম্প্রদায়ভুক্তব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান-সংবলিত যেকোনো আইন কার্যকর করা হইতে,(গ) যে শ্রেণির কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তাহা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেই রুপ যে কোনো শ্রেণির নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর সংরক্ষন করা হইতে রাষ্ট্রকে নিভৃত করিবে।সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদের বলা আছে নারীর প্রতিনিধিত্ব করার কথা। নারীর জন্য জাতীয় সংসদে ৫০ টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। ৯ অনুচ্ছেদের অধীনে স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান সমূহের উন্নয়নে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন তুলনামূলকভাবে কম লক্ষ করা গেছে। তার মধ্যে আদালতপাড়া অন্যতম। সুপ্রিম কোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এখানকার উভয় বিভাগেই ক্ষমতায়নের দিক থেকে নারীদের অবস্থান শোচনীয়। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে বিচারপতি রয়েছেন ৯৯ জন। তাদের মধ্যে মাত্র ৬ জন নারী বিচারপতি।
অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে ২২২ জন আইন কর্মকর্তা রয়েছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল পদে কোন নারী নেই। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ৬৭ টি জনের মধ্য ১২ জন নারী। সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ১৫১ জনের মধ্যে ৫৫ জন নারী। সারাদেশের বিচারিক আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা নাই বললেই চলে। আমার জানা মতে সুনামগঞ্জ জেলায় একমাত্র নারী পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আছেন। গর্ভমেন্ট প্লিডার (জি,পি) বা অন্যকোনো উচ্চপদে নারী আছে বলে জানা নেই।
Advertisement
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতৃত্বেও নারীদের সংখ্যা কম। প্রতিষ্ঠানটির ২০২০-২০২১ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচিত কমিটিতে ১৪ পদের মধ্যে পদে মাত্র ১জন নারী সদস্য। যদিও ৮০০ জনের মতো নারী আইনজীবী উকালতি করছেন এখানে। তবে কোন ভালো পদ, পদবীতে নারীদের নমিনেশনও এখানে কম দেয়া হয়। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি সম্পাদক পদে নারী নেতৃত্ব আসেনি।
বাংলাদেশে ৫৮ হাজার আইনজীবীর মধ্যে নারী আইনজীবী প্রায় ১০ হাজার। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে নারী প্রতিনিধি নেই, নির্বাচনে নারীদের নমিনেশন তেমন একটা দেয়া হয় না। আমরা নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলি, নারীদের পদায়নের কথা বলি, নারী নেতৃত্বের কথা বলি, নারী অধিকারের কথা বলি, নারী অধিকার বাস্তবায়নের জন্য আমরা সোচ্চার অথচ সবচেয়ে বঞ্চনার শিকারই নারীরা। তবে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী তাই তিনি সবসময় যেকোন নিয়োগে নারীদের চান, প্রত্যাশা করেন নারীর ক্ষমতায়ন।
প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি পূর্ণরুপে বিশস্ত থাকলে নারীর প্রতি কোনও রকম বৈষম্য থাকার বা বৈষম্যমূলক কোনও আচরণ করার সুযোগ নেই। অধিকার আদায়ে প্রতিনিয়ত লড়াই করছেন নারীরা। কখনো লাভবান কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তবে নারীর ক্ষমতায়নের আশার দিকও আছে। সেটি হচ্ছে আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকার একজন নারী, বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পরিষদে ৪ জন নারী, বিরোধী দলীয় নেত্রী নারী, সংসদে সরাসরি নির্বাচিত ২২ জন এবং সংরক্ষিত ৫০ টি আসনে নারী।
এছাড়া দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় জেলাপ্র্রসাশক হিসেবে দায়িত্ব¡ পালন করছেন নারী। সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্বে রয়েছেন ১০ জন নারী। পুলিশ প্রশাসনে ৫ জন ডিআইজি, ৬৯ জন পুলিশ সুপার (এসপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নারী। বিচার বিভাগে অনেকেই জেলা জজের দায়িত্ব পালন করছেন নারী। দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিসির দায়িত্ব পালন করছেন নারী। হাসপাতাল গুলোতে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন নারী, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে প্রতিনিধিত্ব করছেন নারী, বিভিন্ন এনজিওতে নারী, সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের শীর্ষ সংগঠনের নেতৃত্বে নারী।
লেখক : আইন সাংবাদিক।
এইচআর/জেআইএম