মাত্র এক কেজি বরই দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। প্রথমে ভেবেছিলেন বিক্রি না হলে নিজেই খাবেন। এ বরই দিয়ে তৈরি আচারই বিক্রি করেছেন দোকানে ফেরি করে। নিজের অদম্য ইচ্ছা ও মানসিক শক্তির জোরে দাঁড়িয়েছেন নিজের পায়ে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন তার অর্ডার আসে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ, আমেরিকা থেকেও।
Advertisement
সফল এ নারী উদ্যোক্তা হবিগঞ্জ শহরের নাতিরাবাদ এলাকার বাসিন্দা সিরাজ মিয়ার মেয়ে মনোয়ারা বেগম। তিনি এখন স্বপ্ন দেখেন একটি কারখানা স্থাপনের। গড়ে তুলতে চান শিল্প প্রতিষ্ঠান। তার চোখে মুখেও সে স্বপ্নের হাতছানি।
অসুস্থ বাবা, এক ভাই ও তিন বোন মিলে তাদের সংসার। মা মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় মনোয়ারা। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। ভাইও বিয়ে করেছেন। একমাত্র তিনিই অবিবাহিত।
মাদরাসা থেকে দাখিল পাস করলেও পরবর্তীতে ভর্তি হন কলেজে। বিএ পাস করে এখন পড়ছেন এমএ। গত কয়েক বছরে চাকরিও করেছেন একাধিক। কিন্তু সেগুলো স্থায়ী হয়নি বেশি দিন। প্রতিটি চাকরিই ছিল বিভিন্ন এনজিওর প্রকল্পের কাজ। প্রকল্প শেষ তো চাকরিও শেষ।
Advertisement
এরপর থেকে শুরু করেন টিউশনি। কিন্তু গত বছর করোনার শুরু থেকে সেটাও বন্ধ হতে শুরু করে। তখনই সিদ্ধান্ত নেন এভাবে আর চাকরি বা টিউশনির পেছনে ছোটা নয়। নিজেকেই কিছু তৈরি করতে হবে। নিজের প্রতিষ্ঠান গড়তে হবে।
সে চিন্তা থেকেই মাত্র এক কেজি বরই বাজার থেকে কিনে আনেন। তা শুকিয়ে মজাদার আচারও তৈরি করেন। ভাবলেন যেটুকু বিক্রি হয় হলো, বাকিটা প্রয়োজনে নিজেই খাবেন। প্রথমে সেই আচার ফেরি করে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করতে লাগলেন। অনেকেই আড়চোখে তাকালেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তিনি পেয়েছেন উৎসাহ। এক পর্যায়ে স্বজন ও বন্ধুরা তাকে অনলাইনে ব্যবসার স্বপ্ন দেখান। তারা সহযোগিতাও করেন।
ফেসবুকে নিজের একটি পেজ করেন। যুক্ত হন নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন ফেসবুক পেজে। তার মাধ্যমেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্ডার আসতে থাকে। ক্রমেই তার ব্যবসা প্রসারিত হতে থাকে। দিন দিন তার পণ্যের পরিমাণ বাড়ান। বিভিন্ন জাতের মজাদার আচার তৈরি করেন মনোয়ারা।
এর মাঝে বরই, সাতকরা, জলপাই, আমড়া, রসুন, চালতা, আয়লা, আমের কাশ্মিরী আচার অন্যতম। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এসব আচারের অর্ডার এখন বিদেশ থেকেও আসে। সর্বনিম্ন প্রতি কেজি বরইর আচার ৩০০ এবং সর্বোচ্চ আয়লা এবং আমের কাশ্মিরী আচার ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। অন্যান্য আচারও ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন, যা বাজারে পাওয়া অন্যান্য আচারের থেকে সুস্বাদু এবং দামেও কম।
Advertisement
এছাড়া শুকনা সাতকরা বিক্রি করেন প্রতি কেজি ১ হাজার ২০০ টাকা। সব খরচ বাদ দিয়েও মাসে এখন তার ব্যবসার মাধ্যমে গড়ে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় হয়। তা দিয়ে নিজের খরচ চালিয়ে সংসারেও অবদান রাখছেন।
জানতে চাইলে মনোয়ারা বেগম জানান, বাজারের আচারের মান ভালো না হওয়ায় নিজেই আচার তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে ভাবলেন বিক্রি না হলে নিজেই খাবেন। আচার বানাতে তেমন দক্ষও ছিলেন না। নিজে নিজেই শিখেছেন। প্রথমে নিজের তৈরি আচার বিভিন্ন ছোট ছোট দোকানে গিয়ে বিক্রি করেন। তখন অনেকেই উৎসাহ দিতেন। সাহস জোগাতেন। অনেকেই আবার উল্টো বলতেন। সমালোচনাও করতেন। কিন্তু সমালোচনার থেকে উৎসাহেই বেশি সাহস পান।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি দেশের সব পুরুষই আমাকে সাহস জোগায়। আমার সাথে আছে। এ ব্যবসায় অনেক বেগ পেতে হয়েছে। খাওয়ার পর অনেকেই বলেন আচার নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু যখন বলি দেখান। তখন আর পারে না। এড়িয়ে যায়। আবার অনলাইনে অনেকেই অর্ডার দিয়ে বলে দাম বেশি। অন্য জায়গায় কম দামে পাওয়া যায়। আরও কত কথাই না শুনতে হয়।
এখন তিনি একটি কারখানা স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন জানিয়ে বলেন, চাকরি আজ আছে তো কাল নেই। চাকরির পেছনে ছুটে সময়ও নষ্ট। এর থেকে নিজে একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে পারলে তা একান্তই আমার মালিকানার হবে। আমি মারা গেলে আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম চাকরি নাও পেতে পারে। কিন্তু আমি যদি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়তে পারি তাহলে তার মালিকানা আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবে।
নারীদের নিয়ে কাজ করা জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের উপ-পরিচালক মাহবুবুল আলম জানান, হবিগঞ্জ জেলা একটি রক্ষণশীল এলাকা। এখানকার মানুষ ধর্মপরায়ণ। এরপরও এখন মানুষ অনেকটাই বুঝতে শুরু করেছে। অনেক মেয়েই এখন ঘরে বসে বিভিন্ন ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তা সম্ভব হচ্ছে ডিজিটালাইজেশনের ফলে।
তিনি বলেন, অনলাইন ব্যবসা এখানে একেবারেই নতুন। করোনা আসার পর মানুষ অনলাইন ব্যবসায় ঝুঁকছে। অনেক মেয়েই এখন অনলাইনে বিভিন্ন পণ্য বেচাকেনা করছেন। তাদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি, বাজার তৈরি, পণ্য রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।
তিনি আরও বলেন, মনোয়ারা বেগম মহিলাবিষয়ক অধিদফতর থেকে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসা প্রসারিত করেছেন। আমরা তাকে বিভিন্ন সময় পরামর্শ দিয়ে থাকি।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মর্জিনা আক্তার বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার পেছনে মেয়েদেরও ভূমিকা রয়েছে। মেয়েরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে আমাদের এ প্রচেষ্টা রয়েছে।
তিনি বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতায় বিভিন্ন বিষয়ে নারী উদ্যোক্তা তৈরি করছি, যাদের মাধ্যমে বিভিন্ন ছোট ছোট শিল্প গড়ে উঠবে। পণ্য কীভাবে বাজারজাত হবে, কীভাবে সংরক্ষণ হবে, কীভাবে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা শক্তিশালী হবে সে ব্যাপারে সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আমরা এর বাস্তবায়ন করছি।
বাজারের বিস্তার লাভে নারী উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সফলতা লাভের জন্য মাঝখানে যে বাধা আসে তা খীভাবে অতিক্রম করা যায় সে বিষয়েও তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা আছে।
সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন/এফএ/জেআইএম