খুব সম্ভবত নারী দিবস, নারী অধিকার, নারী আন্দোলন শব্দগুলোর উদ্ধব হয়েছে বহুযুগের বহু উপেক্ষিত নারীর উপাখ্যান থেকে কিংবা বঞ্চিত নারীর প্রতিবাদের ভাষা থেকে। এ দিবসটি শতাব্দী-প্রাচীন আন্তর্জাতিক দিবস। ১৯০৯ থেকে ১৯১১ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ড সূচিত এই দিবস পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে উদযাপিত হয়। জাতিসংঘ দিবসটি উদযাপন শুরু করে ১৯৭৫ সাল থেকে। এখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপিত হয়।
Advertisement
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮(২) ধারায় বলা হয়েছে “রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন”। আমার মনে হয়, নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন - কথাটি দ্বারা বরং নারী-পুরুষ দ্বন্দ্বটিকে আরও প্রকট করা হয়। তাছাড়া ‘পুরুষ’ শব্দটি তো আদর্শের মাপকাঠি হতে পারে না। তাই একজন নারীর মেয়ে মানুষ নয়- চাই মানুষ হবার অধিকার। ধারায় উল্লেখিত উপর্যুক্ত বাক্যটি যদি একটু ঘুরিয়ে বলি “রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সম-অধিকার লাভ করিবেন”- আমার ধারণা তাতে অযৌক্তিক কিছু হবে না বরং নারী পুরুষের ভেদাভেদটির উপরে একটু সমতার প্রলেপ দেয়া হবে।
বাংলাদেশের নারী সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থানগত চিত্র উপস্থাপন করতে গেলে দেখা যায় যে, এখানে নারীর গৃহকর্মকে অর্থনৈতিক কাজ বলে পুরুষ স্বীকার করেনা। অন্য দিকে আবার নানা পারিবারিক ও সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নারীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখে। কানাডা ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন হেলথ ব্রিজের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী নারীরা গৃহে প্রতিদিন ৪৫ রকমের এবং গড়ে ১৬ ঘন্টা কাজ করেন। ২০১২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী নারীরা গৃহস্থালির কাজে যে অবদান রেখেছেন তার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ২২৭ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২৫৮ দশমিক ৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশের জিডিপির দ্বিগুণেরও বেশি। তাই রাষ্ট্রিয়ভাবে যদি একজন নারীকে গৃহকর্মী হিসেবে নয় একজন গৃহ-ব্যবস্থাপক হিসেবে সম্মাননা ও বেতন প্রদান করা হয় তবে তা পুরুষ-তান্ত্রিকতার মূলে আঘাত হানবে।
পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে নারীরা সুষম খাবার গ্রহণের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম পুষ্টিমানের খাবার গ্রহণ করে। যার কারণে নারীরা ভয়ানক পুষ্টিহীনতার শিকার হচ্ছে। ২০১১ সালের পুষ্টি জরিপ মতে, বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৯৫ লাখ শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ৫৬ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় কম ওজন নিয়ে। মাছের মাথা কিংবা মুরগীর রান শুধু ছেলে শিশুটির পাতে নয় মেয়ে শিশুটির পাতেও দিতে হবে। এতে করে ছেলে-মেয়ে উভয়েরই শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক গঠন সমান হবে।
Advertisement
গ্রামীণ সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, বেশির ভাগ বাবা-মা তার মেয়ে শিশুকে প্রাথমিক লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে গার্মেন্টস শিল্পের সাথে যুক্ত করছে। জরিপে দেখা গেছে, গার্মেন্টস শিল্পে বিদ্যমান শ্রমের প্রায় ৮১ শতাংশই নারী। এসব নারীরা নিজ পরিবারের দারিদ্র্য অবস্থা দূরীকরণের সাথে সাথে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখলেও তারাই সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত, বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত আমাদের পরিবারে, সমাজে।
কোন কোন নারীর সামাজিক স্বীকৃতি মিললেও স্বীকৃতি মিলছে না পরিবারে। পরিবারে তারা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রথমবারের মতো নারী নির্যাতন নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে চালানো জরিপ প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে, দেশের বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো সময়ে কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৮৫ শতাংশ নারীর উপার্জনের স্বাধীনতা নেই।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দীর্ঘ নয় মাসে প্রায় ২ লাখ নারী পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্পে বন্দি থেকে নির্মমভাবে সম্ভ্রম হারায়। একাত্তরে নির্যাতিত এ নারীদের উপাধি বীরাঙ্গনা। স্বাধীনতার পর দেশের জন্য যারা যুদ্ধ করেছিল সেসব মুক্তিযোদ্ধাদের যথাসাধ্য রাষ্ট্র সম্মানিত করেছে। কিন্তু বীরাঙ্গনাদের চিহ্নিত করে তাদের যথাযথ সাহায্য- সহযোগিতা দেয়ার ব্যবস্থা করেনি। তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে শুধুই ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করার ফলস্বরূপ তারা আজ ‘ধর্ষিতা’ বলে পরিবার ও সমাজ থেকে বিছিন্ন ও নিন্দিত। আমরা চাই, বীরাঙ্গনাদের পুর্ণবাসনের ব্যবস্থা করে সরকার তাদেরকে যথাযথ সম্মান দেবে।
মাঠে নেমে নারী অধিকার চাই বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার না করে নারী-পুরুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রথমত রাষ্ট্রের মস্তিষ্কের পরিবর্তন করতে হবে- সংবিধানের ধারায় পরিবর্তন এনে এবং দ্বিতীয়ত এখন থেকে মেয়ে শিশুটিকে মর্যাদা ও মূল্যসহ তার মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতাগুলো ভোগ করার সুযোগ পরিবারকে দিতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(১) নং ধারায় রয়েছে, “ধর্ম, গোষ্ঠি, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না”।
Advertisement
পক্ষান্তরে, রাষ্ট্রের ব্যক্তিগত সম্মতির আইন অনুযায়ী নারীর সম্পত্তি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ধর্মভেদ ও লিঙ্গভেদ রয়েছে যা মূল সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ব্যক্তিগত সম্পত্তির আইন অনুযায়ী একজন মুসলমান নারী পিতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হিসেবে পায় ভাইয়ের অর্ধেক সম্পত্তি এবং একজন হিন্দু নারী পিতার সম্পত্তির কোন উত্তরাধিকার হতে পারে না। তাই সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করে পিতার সম্পত্তি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ধর্মভেদ কিংবা লিঙ্গভেদ না করে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তাহলেই নারীদের পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের কণ্ঠ তখন সরব হবে। যার ফলে দেশ এগিয়ে যাবে শোষণ-মুক্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে।
লেখক : কবি, গবেষক।
এইচআর/জেআইএম