কয়েকবছর আগে নয়াদিল্লীর সাকেট হাসপাতালে গিয়েছিলাম ব্যাকপেইনের চিকিৎসার জন্য। সেখানে আল্ট্রাসনোগ্রাম রুমের সামনে একটা সাইনবোর্ড দেখে চমকে উঠেছিলাম। ছবি তুলে রেখেছিলাম। কিন্তু মোবাইলের অ্যালবামে ছবিটি খুঁজে পাইনি। ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ডটির অনুবাদ কাছাকাছি এমন, ‘এখানে গর্ভের শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয় না। জন্মের আগেই শিশুর লিঙ্গ জানতে চাওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’
Advertisement
বাংলাদেশে হয়তো বিষয়টি শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়, কিন্তু আমরা অহরহ অপরাধটি করি। যদিও আরো অনেকের মত আমরা অপরাধটি করিনি। জন্মের আগে আমাদের একমাত্র সন্তানের লিঙ্গ জানতে চাইনি। তবে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, আমাদের কন্যা সন্তান হবে। আমরা কন্যার নাম ঠিক করে রেখেছিলাম- রিমঝিম আমিন। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আমার স্ত্রী মুক্তি শিকদারকে জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমাকে পাঠানো হয়েছিল, ঔষধ আনতে। হন্তদন্ত হয়ে ঔষধ নিয়ে ফিরে আসতেই বন্ধু সেলিম মোল্লা জানতে চাইলেন, ছেলে চান না মেয়ে? আমি খুব কনফিডেন্টলি জবাব দিলাম, মেয়ে। তখন তিনি হাসতে হাসতে বললেন, যান ছেলে নিয়ে আসুন। আমি আসার আগেই জরুরি রোগীর ঔষধ দিয়েই মুক্তির অপারেশন শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং পৃথিবীতে আসে আমাদের ছেলে সন্তান। অপ্রস্তুত আমাদের উদ্ধার করেছিলেন বন্ধু মুন্নী সাহা। ছেলের নাম রাখলেন- প্রসূন আমিন। এখন বড় হয়ে গেছে। কিছু মনে করে না। কিন্তু ছেলেবেলায় এই গল্প শুনে প্রসূন কান্নাকাটি জুড়ে দিতো।
আমরা জন্মের আগে সন্তানের লিঙ্গ জানতে না চাইলেও মনের অজান্তেই অপরাধটি করে ফেলেছিলাম, আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল কন্যা সন্তান। তবে সাকেট হাসপাতালের আল্ট্রাসনোগ্রাম রুমের সামনে সাইনোবোর্ডটি টানানো হয়েছিল উল্টো কারণে। এই উপমহাদেশে এখনও কন্যাশিশু অনাকাঙ্ক্ষিত সবাই চায় ছেলে। আগেভাগে কন্যাশিশুর খবর জানলে অনেকেই তা নিতে চান না। অনেক কন্যাশিশুর অকালমৃত্যু হয় মাতৃগর্ভেই। এখনও, এই একবিংশ শতাব্দীতেও কন্যাশিশু জন্ম দেয়ার ‘অপরাধে’ অনেক নারীকে হেনস্তার শিকার হতে হয়। অনেকের সংসার ভেঙে যায়। ছেলের আশায় পরপর চার মেয়ের উদাহরণ আমাদের চোখের সামনেই আছে। কন্যা নাকি বোঝা, ছেলে নাকি বংশের প্রদীপ।
শুধু বাংলাদেশ বা এই উপমহাদেশ নয়; বিশ্বজুড়েই নারীরা বঞ্চিত, অবহেলিত। সম্পদের উত্তরাধিকারে নারীর বঞ্চনা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, কিন্তু ন্যায্য অধিকার নারীরা পায়নি কখনোই। এমনকি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হলেও কন্যা পিতা-মাতার সম্পত্তির পুরো অধিকার পায় না। দেশসেরা চিকিৎসক এম আর খানের কন্যা তার পিতার সম্পদের অধিকার পেতে মিডিয়ার দ্বারস্থ হয়েছেন।
Advertisement
পরিস্থিতি বদলাচ্ছে; শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ এবং সাফল্য আগের চেয়ে অনেকে বেড়েছে। পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফলাফল দেখলেই বোঝা যায়, সুযোগ পেলে ছেলেদেরে সাথে সমানতালে পাল্লা দেয়ার মত মেধা এবং সক্ষমতা মেয়েদের আছে। কিন্তু সেই সুযোগটাই সবসময় তারা পায় না। বঞ্চনাটা শুরু হয় একদম ঘর থেকে। যদি কোনো পরিবারে একটা ছেলে এবং মেয়ে থাকে, তাহলে ছেলেটাই সুযোগ-সুবিধা বেশি পাবে; এটা যেন অবধারিত। পরিবার থেকে ছেলের পড়াশোনার জন্য আর মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা রাখা হয়।
মেধাবী হলেও মেয়েটি পড়াশোনার জন্য তার ভাইয়ের সমান সুযোগও পায় না। সাধারণভাবে বাবারা কন্যাকে একটু বেশি আদর করেন। বলাই হয়, সব কন্যাই তার বাবার কাছে রাজকন্যা। কিন্তু সেই রাজকন্যাটিও বাবার কাছ থেকে ন্যায্য অধিকারটুকু পান না। কোনোরকমে বিয়ে দিতে পারলেই যেন বাবা-মায়ের দায়িত্ব শেষ।
করোনাভাইরাস বদলে দিয়েছে গোটা বিশ্বকেই। এমন কোনো খাত নেই করোনার অভিঘাত যেখানে লাগেনি। তবে বাংলাদেশে করোনা ঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থাকে। একবছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আগামী ৩০ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কথা। সামগ্রিকভাবে ক্ষতি হলেও শিক্ষায় নারীদের অগ্রগতির যে ক্ষতি করোনার সময় হয়েছে, তা আসলেই অপূরণীয়।
অনেক কন্যা শিশু বা মেয়ে আগামী ৩০ মার্চ আর স্কুলে ফিরবে না। শহরের কথা বাদ, গ্রামে মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়, ঘরে-বাইরে হাজারটা লড়াই করে। করোনা সেই লড়াইটা আরো কঠিন করে দিয়েছে। করোনার সময় বাল্যবিয়ে বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। বাবা-মা কোনোভাবে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ঘাড় থেকে বোঝাটা নামিয়ে ফেলতে চান। আপন পিতা যদি কন্যাকে সংসারের বোঝা মনে করে, তাহলে সমাজের আর দোষ দিয়ে লাভ কী?
Advertisement
এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। তবে শুধু মিষ্টি মিষ্টি ভালো কথায় কাজ হবে না। উদাহরণ দিয়ে হাতেনাতে বাবা-মাকে বোঝাতে হবে ছেলে আর মেয়েতে কোনো পার্থক্য নেই। অন্তত আপনারা আদর-স্নেহ-সুযোগ-সম্পদে বৈষম্য করবেন না। আপনার প্রিয় কন্যার সব সামর্থ্য আছে, প্রয়োজন শুধু যথার্থ সুযোগের। কন্যাশিশুরাও যে সুযোগ পেলে ছেলেদের সাথে পাল্লা দিতে পারে, তার ভুরি ভুরি উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল শিটে আছে।
লিখলাম বটে সুযোগ পেলে মেয়েরা ছেলেদের সাথে সমানতালে পাল্লা দিতে পারে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি মেয়েরা যে কোনো বিবেচনায় ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে। নারীরা অনেক বেশি দায়িত্বশীল, সময়ানুবর্তি, সৃশৃঙ্খল, মানবিক, মমতাময়ী। একটা ছেলে শুধু একটাই চাকরি করে। আর কর্মজীবী নারীরা একসঙ্গে অফিস সামলায়, ঘর সামলায়, সন্তানের দেখাশোনা করে।
মন থেকে পুরুষতন্ত্রের জগদ্দল পাথরটা সরিয়ে একটু চারপাশে তাকান, আপনিও মানবেন নারীরাই বেশি যোগ্য, বেশি দায়িত্বশীল। এখন আর ছেলেদের পেশা, মেয়েদের পেশা বলে আলাদা কিছু নেই। সুযোগ পেলে মেয়েরা সবক্ষেত্রেই নিজেদের সক্ষমতার, সামর্থ্যের প্রমাণ রেখেছেন। ট্রেন থেকে বিমান সবকিছুই চালাতে পারে নারীরা, পারে দেশ চালাতেও। শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই নন, বিশ্বের যেখানেই নারীরা সুযোগ পেয়েছেন, দারুণভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বা নিউজিল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা অর্ডানের উদাহরণ তো চোখের সামনেই।
সমানতালে লড়ার জন্য কন্যাশিশুদের শুধু দরকার সুযোগ। অন্তত লড়াইয়ের ময়দান পর্যন্ত যাতে যেতে পারে। প্রিয় অভিভাবক, আপনি নিজে দায়িত্ব আপনার কন্যাকে লড়াইয়ে পাঠান। আপনার এত প্রিয় কন্যা, আপনিই যদি তার সাথে বৈষম্য করেন, তাকে বোঝা ভাবেন; সমাজ-রাষ্ট্র আর আমাদের মগজে গেঁথে যাওয়া পুরুষতন্ত্র তো তার জীবন অসহনীয় করে তুলবে। তখন কেমন লাগবে আপনার? কন্যার জন্য চোখের পানি ফেলে আর লাভ হবে না। কারণ কন্যার এই পরিণতির জন্য আপনিই দায়ী। তাকে ঠিকমত পড়াশোনা করার সুযোগ দেননি, নিজের পায়ে দাড়ানোর আগেই বিয়ে দিয়ে বিদায় করেছেন। এখন কেঁদে কেটে লাভ হবে না।
অনেকেই মেয়েকে কোনোরকমে বিয়ে দেয়ার মত করার জন্য পড়ান। আর সব বিনিয়োগ করেন ছেলে সন্তানের পড়াশোনার পেছনে। ভাবেন, ছেলে বড় হয়ে সংসারে হাল ধরবে, বাবা-মাকে দেখে রাখবে। কিন্তু সবসময় তা নাও হতে পারে। সব সঞ্চয় বিক্রি করে ছেলেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠালেন, সে হয়তো আর ফিরলোই না। আপনার শেষ আশ্রয় হবে বৃদ্ধাশ্রমে। দেশে থাকা ছেলেরাও সবসময় স্ত্রীর কারণে বাবা-মাকে দেখে রাখতে পারেন না। ছেলের সংসারে বাবা-মায়ের অনাদর-অবহেলা জোটার উদাহরণ ভুরি ভুরি। কিন্তু কন্যার সামর্থ্য যেমনই হোক, কখনো বাবা-মাকে ফেলে দেয় না।
প্রিয় অভিভাবক, সন্তান ছেলে হোক আর মেয়ে হোক, আপনার জন্য সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ। তার প্রতি সুযোগে, সম্পদে বৈষম্য করবেন না। তাকে সুযোগ দিন লড়াইটা করার, নিজেকে প্রমাণ করার।৭ মার্চ, ২০২১
এইচআর/জেআইএম