কথারও একটি মোহিনী শক্তি আছে। কথার মাধ্যমে মানুষকে আন্দোলিত করা যায়। জাগিয়ে তোলা যায়। বিপ্লব ঘটানো যায়। সমাজে ঐতিহাসিক পরিবর্তন আনা যায়। অত্যাচারী শাসকদের পতন ত্বরান্বিত করা যায়। কিন্তু সবার এ গুণ থাকে না। বিশ্বের কতিপয় ব্যক্তির ভাষণ ইতিহাস হয়ে আছে। তাদের ভাষণের মাধ্যমে তারা সমাজ ও রাষ্ট্রে ঐতিহাসিক পরিবর্তন আনতে পেরেছিলেন। কেউ জাতীয় স্বাধীনতায় জনগণকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। কেউ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছেন। কেউ বা ভাষণের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনে অবদান রেখেছেন।
Advertisement
বিশ্বে মোটামুটি ১৫-২০টি ভাষণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সেই ভাষণগুলো বিশ্ব পরিচিতি ও স্বীকৃতি পেয়েছে। তাদের মধ্যে মার্টিন লুথার কিং, জুনিয়র (Martin Luther King, Jr.) এর civil Right নামে খ্যাত ভাষণটি শুধু আমেরিকা নয়, বিশ্বব্যাপী খ্যাত। মার্টিন লুথার ছিলেন আফ্রিকান আমেরিকান। তিনি বর্ণবৈষম্য বিলোপ, শান্তি ও নাগরিকদের মৌলিক অধিকার বা civil Right এর জন্য নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান-আমেরিকানদের মৌলিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৬৩ সালর ২৮ আগস্ট এক বিরাট মিছিলের নেতৃত্ব দেন, যা 1963 March on Washington’ নামে পরিচিতি পায়। মিছিল শেষে ওয়াশিংটনের লিংকন মেমোরিয়াল মঞ্চে এ ভাষণটি দেন। তা ছিল বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে। তিনি বলেছিলেন, Ò I have a dream that my four children will one day live in a nation where they will not be judged by the color of their skin but by the content of their character.”
মার্টিন লুথারের ওই ভাষণের পর আমেরিকায় বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং সিভিল রাইট প্রতিষ্ঠায় অনেক আইন তৈরি হয়।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর পেনসেলভেনিয়ার গেটিসবার্গের জাতীয় সমাধিস্থলে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি গণতন্ত্র ও শহীদের আত্মোৎসর্গের কথা বলেন। তিনি বলেন- ‘‘that we here highly resolve that these dead shall not have died in vain, that this nation, under God, shall have a new birth of freedom –and that government of the people, by the people, for the people, shall not perish from the earth.”
Advertisement
দ্বিতীয় যুদ্বের সময় প্রায় গোটা বিশ্ব সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল। ব্রিটিশ শাসকরা ভারত উপমহাদেশকেও যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেছিল। মহাত্মা গান্ধী অহিংস নীতিতে রাজনীতি করতেন। তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন করেছেন। ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে তিনি এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি ব্রিটিশ শাসকদের ভারতবাসীদের স্বাধীনতা দিয়ে ভারতবর্ষ ছাড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর ওই ভাষণ ভারত ছাড় বা ‘Quit India’ নামে পরিচিত, যা বিশ্বে একটি বিখ্যাত ভাষণ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, Ò In the democracy which I have envisaged, a democracy established by non-violence, there will be equal freedom for all. Everybody will be his own master.”
বিখ্যাত ভাষণগুলোর মধ্যে আছে ব্রিটেনের রানী অ্যালিজাবেথ- ১ এর ১৫৮৮ সালে প্রদত্ত টিলবেরী (Tilbury) ভাষণ। ওই ভাষণে ব্রিটিশ সেনারা উজ্জীবিত হয়ে স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে। ১৯৬৪ সালে প্রদত্ত নেলসন মেন্ডেলার ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৭৭৫ সালের আমেরিকার ভার্জেনিয়ার স্ট্যাটসম্যান পেট্রিক হেনরীর ভাষণ, ১৭৯৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রদত্ত জর্জ ওয়াশিংটনের `Farewell Address or Resignation Speech’, ১৯৪০ সালে ব্রিটেনের আইন সভায় দেয়া উইস্টন চার্চিলের Ô We shall fight on the beaches’ ভাষণ, ইত্যাদি।
বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ইউনেস্কোর Memory of the world register -এ নিবন্ধিত হয়েছে। এখন এটি বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টারি হেরিটেজের অংশ।
একটি কঠিন ও জটিল পরিবেশে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন। একদিকে স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার জন্য ছাত্র-জনতার প্রবল চাপ, অন্যদিকে পাকিস্তান সামরিক জান্তাদের রক্তচক্ষু। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিলে পূর্ব পাকিস্তানকে তামা বানিয়ে দেবে। মাটি থাকবে মানুষ থাকবে না। ইয়াহিয়ার সেনা কর্মকর্তাদের এমন হুমকি ছিল। সেই পরিবেশে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন।
Advertisement
ভাষণে কি বলবেন সে বিষয়ে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা নানা রকম পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজের মতো করে নিজের ভঙ্গিতে ভাষণ দেন। কোনো লিখিত বক্তব্য ছিল না, কোনো নোট ছিল না। তিনি আসলেন, মঞ্চে উঠলেন। উপস্থিতভাবে মনে যা আসলো তাই বললেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ তার কবিতায় বলেছেন-
“ কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠবাণী? গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি।”
এ অমর কবিতায় বঙ্গবন্ধু বাঙালির মনের কথা বলেছেন, আবেগের কথা বলেছেন, বাঙালির শোষণ, বঞ্চনা ও অধিকার হনন, আর্তনাদ ও বাঙালির রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস বলেছেন। সামরিক আইন তুলে নেয়া, সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া, সব হত্যার তদন্ত করা এবং জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এ চারটি দাবি করে তিনি আলোচনার পথ খোলা রেখেছিলেন। একই সাথে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য তিনি জনগণকে প্রস্তুত থাকতেও পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন- ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদেও কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দিবে।... মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।”
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।”-এ কথা বলে বঙ্গবন্ধু তাঁর সামনে স্বাধীনতাকামী দশ লক্ষ লোকের সামনে ১৮ মিনিটের ভাষণ শেষ করেন।
৭ই মার্চের ভাষণ ছিল একজন দূরদর্শী, প্রজ্ঞাবান ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদের কৌশলী স্বাধীনতার ঘোষণা। সেখানে গেরিলা যুদ্ধেরও ঈঙ্গিত ছিল। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তান শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না বরং জুলুম বাড়িয়ে দিবে। তখন বাঙালীরা তাঁর এ ভাষণের আলোকে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু করবে। এছাড়া বাঙালিদের আর কোন পথ থাকবে না। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন আক্রমণটা আগে পাকিস্তানীদের তরফ থেকে আসুক, বাঙালিরা প্রতিরোধ করবে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবে। তখন বিশ্ববাসীর সমর্থন পাওয়া যাবে। আসলে সেটাই হয়েছে।
২৫শে মার্চ, ১৯৭১ দিবাগত রাতে পাক সেনারা অপারেশন সার্চলাইটের নামে ঢাকাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ট্যাংক ও কামান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করলে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে। পুলিশ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের নির্দেশনা মোতাবেক যুদ্ধ শুরু করে দেয়। তারা নতুন করে কোন আদেশের অপেক্ষায় ছিল না। পুলিশই প্রথম বিদ্রোহ করে। বাঙালি সেনারা পরে বিদ্রোহ করে। পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে ২৫শে মার্চ প্রথম প্রতিরোধের গুলিটি ছোড়া হয় পুলিশের ’৩০৩ রাইফেল থেকে।
বিশ্বের বিখ্যাত অধিকাংশ ভাষণই ছিল লিখিত। পরিবেশ প্রতিকূল ও মানসিক চাপও ছিল না যা ৭ই মার্চের ভাষণের প্রাক্কালে ছিল। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে স্বাধীনতাকামী একটি নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য জাগিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর এ ভাষণ বিশে^র স্বাধীনতাকামী, অধিকার বঞ্চিত, নির্যাতিত মানুষের জন্য শাশ্বত অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তাই এ ভাষণ জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে।
লেখক : সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ।
এইচআর/এমএস