তাসনুভা আনান শিশির একটি আলোচিত নাম। বাবা সামসুল হক, মা জামিরুন বেগম। খুলনার বাগেরহাটে ১৯৯১ সালের ১৬ জুন তার জন্ম। তিনি নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে সমাজকর্ম বিভাগে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেন। পাশাপাশি ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ থেকে পাবলিক হেলথ বিষয়ে আরও একবছরের জন্য মাস্টার্স করছেন।
Advertisement
তিনি দেশের ফার্স্ট ট্রান্সজেন্ডার উইমেন হিসেবে সফল হয়েছেন। তার সফলতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজেদুর আবেদীন শান্ত-
জাগো নিউজ: আপনার ছেলেবেলা কেমন কেটেছে?তাসনুভা আনান: আট-দশটা ছেলে-মেয়ের মতো কাটেনি। যদি বলা হয়, কোন বেলায় ফিরে পেতে চাও? সবাই বলবেন, ছেলেবেলা। আমি কখনোই ছেলেবেলা ফিরে পেতে চাইনি। আমার ছেলেবেলাটা খুবই বিধ্বস্ত, খুবই বিধ্বস্ত এবং খুবই বিধ্বস্ত ছিল। ছেলেবেলায় কেউ আমাকে বোঝেননি। সারাজীবন আমি মানুষের ট্রল, বুলিংয়ের শিকার হয়েছি। তাই আমি কখনোই ছেলেবেলা ফিরে পেতে চাই না। এতটাই বিধ্বস্ত ছিল আমার ছেলেবেলা।
জাগো নিউজ: ছেলেবেলার একটি মজার ঘটনা শুনতে চাই-তাসনুভা আনান: আমার ছেলেবেলায় কোনো মজার ঘটনা নেই। আগেই বলেছি, বিধ্বস্ত ছিল আমার ছেলেবেলা।
Advertisement
জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?তাসনুভা আনান: হ্যাঁ। পড়াশোনায় প্রতিবন্ধকতা বলতে, অনেকেই নানা রকম মন্তব্য করতো। বুলিং করতো। হ্যারেজমেন্ট করতো। ছেলেবেলায় খুব বাজে ধরনের ঘটনা ঘটেছে। হ্যারেজমেন্টের মতো, যার কারণে পড়ালেখার অনেক ক্ষতি হয়েছিল।
জাগো নিউজ: কলেজ জীবন কেমন কেটেছে?তাসনুভা আনান: সবাই যখন স্কুলের টিফিনে ভাবতেন, আমি কী করবো, কোথায় ঘুরতে যাব, কী খাবো? আমি তখন ভাবতাম, আমি কী করবো, কীভাবে টাকা জোগাড় করবো আমার পড়ালেখা চালানোর জন্য। সমাজে আমাকে কেউ সহজভাবে নিচ্ছেন না। একটা ছেলে গেটআপে একটা মেয়েলি আচরণের ছেলে। গলার স্বর মেয়েদের মতো। কেউ এটা অ্যাকসেপ্ট করছে না। আমার কোনো ফ্রেন্ড নেই। কোনো কথা বলতে পারছি না। সো, এভরি হোয়ার বি চ্যালেঞ্জ। শুধু অনার্সে এসে দু’জন টিচার পেয়েছি; যারা আমাকে নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছেন। একজন হারুন স্যার আরেকজন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া স্যার। এ দু’জন মানুষ যখন এলেন; তখন আমি দিশা পেলাম।
জাগো নিউজ: আপনার সফলতার গল্প শুনতে চাই-তাসনুভা আনান: প্রথম সফলতার গল্প যদি বলি, আমি ফার্স্ট ট্রান্সজেন্ডার উইমেন হিসেবে ব্রাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ থেকে স্কলারশিপ পেয়েছি। দ্বিতীয় সফলতা হলো, ডব্লিউএইচও থেকে টিডিআর ইন্টারন্যাশনাল স্কলারশিপ পেয়েছি। আমি প্রথম ট্রান্সজেন্ডার নারী, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে সংবাদপাঠিকা হিসেবে কাজ করছি।
জাগো নিউজ: নিজেকে মানসিকভাবে কতটা গড়ে নিয়েছিলেন?তাসনুভা আনান: কোথা থেকে যেন একটা স্পিরিট পেতাম, যে বেঁচে থাকতে হবে এবং বেঁচে থাকার জন্য স্ট্রাগল করতে হবে। স্ট্রাগলের কোনো বিকল্প নেই। আমি জীবনে অনেক রাত না খেয়ে ছিলাম। আমি অনেক দিন বাসা থেকে বের হতে পারিনি আমার টাকা ছিল না বলে। আমি কখনোই মনোবল হারাইনি। আমার বিশ্বাস ছিল, কোনো একটা দিন আসবে; যেদিন আমার এই কষ্টের মূল্যটা আমি পাবো। তাই ওই জায়গাটার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম এবং নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করছিলাম। একজন শিল্পী হিসেবে বাঁচতে চেয়েছিলাম। হয়তো আমার এই এক্সপোজারটা আমার ক্যারিয়ারে, আমার জীবনে নতুন মাইলফলক হিসেবে কাজ করেছে।
Advertisement
জাগো নিউজ: বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ট্রান্সজেন্ডার সংবাদপাঠক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছেন, অনুভূতি কেমন?তাসনুভা আনান: এ অনুভূতি আসলে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশে একটি নতুন মাত্রা তৈরি হলো। নতুনভাবে একটি কমিউনিটির মানুষদের সম্মান করা হলো। আমার ভাবতে অবাক লাগছে, সেই সাথে ভালোও লাগছে যে, মানুষের চিন্তার পরিধিটা বাড়লো। ভাবনার জায়গাটায় মানুষের পরিবর্তনের ছাপ এলো।
জাগো নিউজ: ট্রান্সজেন্ডার অন্যদের প্রতি আপনার উপদেশ বা পরামর্শ কী?তাসনুভা আনান: অন্যান্য ট্রান্সবোন যারা রয়েছেন, তাদের সবার কাছে আমার একটাই অনুরোধ; যোগ্য হওয়াটা সবচেয়ে বেশি দরকার। আপনার জেন্ডারটা একটা বেরিয়েড একটা সোসাইটিতে। সবার চোখে না, কিছু কিছু মানুষের চোখে। তাই তারা যেন আপনার জেন্ডারটা না দেখে গুণটা দেখে; সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া। সবাই যোগ্যতা দেখে। কারণ যোগ্য ব্যক্তিকে কখনো দমিয়ে রাখা যায় না। তাই যার যতটুকু মেধা আছে, জ্ঞান আছে; ততটুকু কাজে লাগিয়ে যোগত্যা অর্জন করা বেশি জরুরি।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?তাসনুভা আনান: পরিকল্পনা বলতে, আমি এখন মাস্টার্স করছি। আগামী বছর মাস্টার্সটা শেষ করতে চাই। সংবাদপাঠক হিসেবে কাজ করছি, এটা করতে চাই। ভবিষ্যতে আমি আমার কমিউনিটি নিয়ে কাজ করতে চাই। তাদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করতে চাই। তাদের অ্যাওয়ারনেসের জন্য কাজ করতে চাই। মোট কথা, প্রত্যেকটি মানুষ যেন তার স্ব-স্ব সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারেন; সেই লক্ষ্যে কাজ করতে চাই। আমার যাত্রা যেহেতু অ্যাক্টিং থিয়েটার থেকে, তাই আমি অভিনয় করতে চাই এবং সারাজীবন পারফরমেন্স করে যেতে চাই।
এসইউ/এমএস