জাতীয়

দুই টাকায় বিশুদ্ধ বাতাস মেলে যেখানে

রাজধানীর হাজারিবাগের বাসিন্দা মো. জাহাঙ্গীর আলম শুক্রবার (৫ মার্চ) সকাল সাড়ে ৬টায় তার দুই শিশুকে নিয়ে ঐতিহাসিক লালবাগ কেল্লার প্রবেশদ্বারের বাইরে টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। বার বার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিলেন। হঠাৎ রিকশার তিনজন যাত্রীকে দেখে হাত উঁচিয়ে লাইনে আসার ইশারা করেন। টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে প্রতি টিকিট দুই টাকা করে ছয়জনের প্রবেশমূল্য বাবদ ১২ টাকা দিয়ে ছয়টি টিকিট কেনেন।

Advertisement

ভেতরে প্রবেশের পর দুই বন্ধু ও তাদের চার ছেলে-মেয়ে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে ভোরের হিমেল হাওয়ায় বুক ভরে নিশ্বাস গ্রহণ করলেন। একটু পরেই ছোট শিশুরা কেল্লার ভেতরের ফুল বাগান ও সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত সবুজ মাঠে ছোটাছুটি শুরু করল। আধ-ঘণ্টার মধ্যেই কেল্লার ভেতরে অসংখ্য নারী-পুরুষ ও শিশুর উপস্থিতি দেখা যায়। কেউ হাঁটছেন কেউ দৌড়াচ্ছেন কেউবা আবার ব্যস্ত ব্যয়ামে। অসংখ্য মানুষের উপস্থিতিতে সরগরম হয়ে ওঠে লালবাগ কেল্লা। ঘণ্টা দেড়েক পর সকাল আটটা বাজতেই নিরাপত্তারক্ষীরা ফাঁকা করে ফেলল কেল্লার চৌহদ্দি।

এমন দৃশ্যপট ঐতিহাসিক লালবাগ কেল্লার নিত্যদিনের। লালবাগ কেল্লার ভেতরে সরকারি কর্মঘণ্টায় প্রবেশ টিকিটের মূল্য ২০ টাকা হলেও ভোর সাড়ে ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত প্রাতঃভ্রমণের জন্য মাত্র দুই টাকা মূল্যের টিকিটে প্রবেশ করার সুযোগ রয়েছে। তাই লালবাগ ও আশপাশের এলাকার বিভিন্ন বয়সী শত শত মানুষ প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে কেল্লায় ছুটে আসেন। বুক ভরে বিশুদ্ধ অক্সিজেন গ্রহণসহ মনোরম পরিবেশে সময় কাটান।

শুক্রবার (৫ মার্চ) সরেজমিন লালবাগ কেল্লা ঘুরে দেখা গেছে ছুটির দিনে অসংখ্য নারী-পুরুষ ও শিশুরা কেল্লার ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকেই পরিবারসহ দল বেঁধে ঘুরতে এসেছেন। গোলাপ ও গাঁদাসহ বিভিন্ন ফুল ফুটে আছে বাগানে। শিশুদের মাঠে নিজেদের মতো করে খেলায় ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়।

Advertisement

রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা জিল্লুর রহমান এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানান, তিনি প্রতি শুক্রবারই এখানে প্রাতঃভ্রমণ করতে আসেন। মাত্র দুই টাকায় মনোরম পরিবেশে প্রাতঃভ্রমণের সুযোগ ইট-পাথরের যান্ত্রিক নগরী ঢাকার আর কোথাও নেই।

লালবাগের কেল্লা ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত মোগল আমলের ঐতিহাসিক নিদর্শন। কেল্লাটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে কষ্টি পাথর, মার্বেল পাথর আর রঙ-বেরঙের টালি।

লালবাগ কেল্লা সম্পর্কে কিছু কথা :

প্রথমে এই কেল্লার নাম ছিল কেল্লা আওরঙ্গবাদ। আর এই কেল্লার নকশা করেন শাহ আজম। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর তৃতীয় পুত্র আজম শাহ ১৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার সুবেদারের বাসস্থান হিসেবে এ দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। মাত্র এক বছর পরেই দুর্গের নির্মাণকাজ শেষ হবার আগেই মারাঠা বিদ্রোহ দমনের জন্য সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লি ডেকে পাঠান।

Advertisement

এ সময় একটি মসজিদ ও দরবার হল নির্মাণের পর দুর্গ নির্মাণের কাজ থেমে যায়। নবাব শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালে ঢাকা এসে পুনরায় দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু করেন। তবে শায়েস্তা খাঁর কন্যা পরী বিবির মৃত্যুর পর এ দুর্গ অপয়া মনে করা হয় এবং শায়েস্তা খাঁ ১৬৮৪ খ্রীষ্টাব্দে এর নির্মাণ বন্ধ করে দেন। এই পরী বিবির সঙ্গে শাহজাদা আজম শাহের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। পরী বিবিকে দরবার হল এবং মসজিদের ঠিক মাঝখানে সমাহিত করা হয়। শায়েস্তা খাঁ দরবার হলে বসে রাজকাজ পরিচালনা করতেন।

১৬৮৮ সালে শায়েস্তা খাঁ অবসর নিয়ে আগ্রা চলে যাবার সময় দুর্গের মালিকানা উত্তরাধিকারীদের দান করে যান। শায়েস্তা খাঁ ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর নানান কারণে লালবাগ দুর্গের গুরুত্ব কমতে থাকে। ১৮৪৪ সালে ঢাকা কমিটি নামে একটি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্গের উন্নয়ন কাজ শুরু করে। এ সময় দুর্গটি লালবাগ দুর্গ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯১০ সালে লালবাগ দুর্গের প্রাচীর সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে আনা হয়। অবশেষে নির্মাণের ৩০০ বছর পর গত শতকের আশির দশকে লালবাগ দুর্গের যথাসম্ভব সংস্কার করে এর আগের রূপ ফিরিয়ে আনা হয় এবং দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

টিকিট প্রাপ্তিস্থান :

লালবাগ কেল্লার দরজার ঠিক ডান পাশেই রয়েছে টিকিট কাউন্টার, জনপ্রতি টিকিটের দাম বিশ টাকা। পাঁচ বছরের কম কোনো বাচ্চার জন্য টিকিটের দরকার পড়ে না। যেকোনো বিদেশি দর্শনার্থীর জন্যে টিকিট মূল্য দুইশত টাকা করে।

বন্ধ-খোলার সময়সূচি :

গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কেল্লা খোলা থাকে। মাঝে দুপুর ১টা থেকে ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত আধ-ঘণ্টার জন্য বন্ধ থাকে। আর শীতকালে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শীতকালেও দুপুর ১টা থেকে ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বন্ধ থাকে।

সারা বছরই শুক্রবার নামাজের জন্য সাড়ে বারোটা থেকে তিনটা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। রোববার সাধারণ ছুটি এবং সোমবার বেলা ২টা থেকে লালবাগ কেল্লা খোলা থাকে। এছাড়া বিশেষ দিবসেও লালবাগ কেল্লা খোলা থাকে।

এমইউ/এমএইচআর/এমএস