মালয়েশিয়ায় মানবপাচার চক্রের বিরুদ্ধে চলছে শুদ্ধি অভিযান। উন্নত জীবনের মিথ্যা প্রলোভন আর আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখিয়ে অসহায় মানুষদের সর্বশান্ত করা এই নরপিশাচদের আইনের আওতায় আনতে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দীর্ঘদিন থেকে মাঠে কাজ করছে।
Advertisement
এরই মাঝে মানবপাচার ও প্রতারণার অভিযোগে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে গ্রেফতার করা হয়েছে কয়েকজনকে। তবে তদন্তের স্বার্থে কারোর নাম প্রকাশ না করার শর্তজুড়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানবপাচার ও সংঘবদ্ধ দালাল চক্র নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে।
মালয়েশিয়ায় অতি সম্প্রতি মানবপাচার ও প্রতারণার দায়ে প্রভাবশালী একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। কয়েকদিন জেলে থাকার পর আইনের ফাঁক ফুকরে আবার বেরিয়ে এসেছেন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়ার পেনাং রাজ্যে বিশেষ অভিযানে দালাল সিন্ডিকেটের দুই সদস্যকে আটক করে অভিবাসন বিভাগ। আটকদের মধ্যে একজন মালয়েশিয়ান নাগরিক অপরজন ভারতীয় নাগরিক।
এদিকে আরেক প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক নেতা সম্প্রতি বাংলাদেশে মানবপাচার ও প্রতারণার দায়ে র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। বর্তমানে রিমান্ডে রয়েছেন ওই নেতা। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রভাশালী ওই নেতাকে ২০০৩ সালে মানবপাচার ও প্রতারণার দায়ে মালয়েশিয়া সরকার তাকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশে পাঠায়।
Advertisement
২০০১৫ সালে থাইল্যান্ডে গণকবর আবিষ্কারের পর সেখানকার সামরিক সরকার মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে। পাচারকারী দলের ১০২ জনকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। আদালতে ৬২ জন দোষী সাব্যস্ত হয়। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সেনাবাহিনীর তিন তারকা বিশিষ্ট জেনারেল।
এদিকে ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় মানবপাচারের চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করে বাংরাদেশের পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের উচ্চ পর্যায়ের অনুসন্ধান কমিটি। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত এ কমিটি প্রমাণ পেয়েছে, মানবপাচারে অর্থায়ন করছে ২৬ হুন্ডি ব্যবসায়ী।
সারাদেশে ৩০০ জনের একটি বিশেষ সিন্ডিকেট মালয়েশিয়ায় মানবপাচারে জড়িত। এদের নাম-ঠিকানা সংযুক্ত করা হয় কমিটির প্রতিবেদনে। ভয়ঙ্করভাবে বিস্তৃত মানবপাচার নিয়ন্ত্রণে আনতে এ-সংক্রান্ত মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নেওয়াসহ আট দফা সুপারিশ করে কমিটি।
অভিযান এবং বিচার কাজের পরও নিরীহ বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকদের পাচারকারী চক্রের অনেকেই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ার তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাহিদ হামিদি বলেছিলেন, মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকায় তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
Advertisement
মালয়েশিয়ার কারও বিচারে সাজা হয়নি। সে সময় দু’জন মিয়ানমারের নাগরিক, একজন বাংলাদেশি এবং একজন থাইল্যান্ডের নাগরিকসহ মোট চার বিদেশির মানবপাচারের অভিযোগে সাজা হয়।
বিগত জি-টু-জি প্লাসে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে দেশি রিক্রুটিং এজেন্সি সরকারের বেঁধে দেয়া ব্যয়ের চেয়ে শ্রমিকপ্রতি আদায় করেছে তিন থেকে শুরু করে সাড়ে চার লাখ টাকা পর্যন্ত। শুরুতেই একজন শ্রমিকের গচ্চা যায় তিন থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা। এরপর মালয়েশিয়ায় নির্দিষ্ট কোম্পানিতে পৌঁছেই পড়েন জিম্মি-বাণিজ্যের কবলে।
পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে কাজ না দিয়ে বসিয়ে রেখে দাবি করা হয় বাড়তি টাকা বা বেতনের অংশ। সেটা দিলেই কাজ মেলে। এখানেও আরেক কারসাজি। ওই শ্রমিক যে কোম্পানিতে এসেছেন, হয়তো তাদের কোনো কর্মক্ষেত্রই নেই; নামমাত্র দালালি কোম্পানি।
তারা তখন শ্রমিককে অন্যত্র চাকরিতে দেয় চুক্তির চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি বেতনে এবং মাসশেষে বাড়তি টাকাটা নিজেরা পকেটস্থ করে। দু-চার মাস পর সেই ভাড়া দেয়া শ্রমিককে চুক্তির প্রাপ্য টাকাও দেয়া হয় না; কেটে রাখা হয় ঋণ, থাকা-খাওয়াসহ নানা অজুহাতে। চুক্তি অনুযায়ী যা করার কথা নয়।
অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন বাংলা ভিশনের অভিবাসন বিষয়ক সাংবাদিক মিরাজ হোসেন গাজী। তারও ভাষ্য, দালালদের প্রতারণার কারণে অনেক কারখানায় বাংলাদেশি শ্রমিকরা ক্রীতদাসের মতো ব্যবহৃত হচ্ছে। দালাল কোম্পানিগুলো অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেশি বেতনে চুক্তি করে শ্রমিকদের কম বেতন ধরিয়ে দিয়ে বাকিটা আত্মসাৎ করে; আবার সেই কম বেতন থেকেও নানা ছুতায় টাকা কেটে নেয়া হয়।
অনেক যুবক বিদেশ গিয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সরকারের উচিত এসব দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া।
এছাড়া কোভিড-১৯’র এই বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে এই লড়াই আরো বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। পাচারকারীরা মহামারী সৃষ্ট বিশৃঙ্খল অবস্থাকে পুঁজি করছে।
এই অপরাধের জন্য তাদেরকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। আমাদের জন্য এখনই সময় স্বাধীনতা সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়ার। মানবপাচার নির্মূলের এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজে সরকারের পাশাপাশি সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান এ সাংবাদিক।
এমআরএম/জেআইএম