সবাই কম-বেশি ‘হেঁচকি’ বা ‘হিক্কা’র সঙ্গে পরিচিত। জীবনে কখনো হেঁচকি হয়নি, এমন মানুষ সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটি একটি কষ্টকর ও একইসাথে বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা। খাবার খাওয়ার সময়, গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজের মধ্যে অথবা অবসর কাটানোর সময় হঠাৎ হেঁচকির প্রকোপ শুরু হওয়াটা খুব সাধারণ একটি বিষয়।
Advertisement
হঠাৎ শুরু হওয়া হেঁচকি বা হিক্কা প্রায়ই বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। অনেক সময় এ বিরক্তিকর হেঁচকি অনবরত চলতেই থাকে, যেন শেষই হতে চায় না। তবে বেশিরভাগ সময় হেঁচকি উঠে কিছুক্ষণ পর এমনিতেই চলে যায়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে হেঁচকি দীর্ঘস্থায়ীও হতে পারে। বিশেষ করে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির জন্য এটি একটি সমস্যা হিসাবে দেখা দিতে পারে।
ফুসফুসের নিচে ডায়াফ্রাম বা মধ্যচ্ছদা নামক পাতলা মাংসপেশীর স্তরের হঠাৎ অনৈচ্ছিক সংকোচনের ফলে সৃষ্ট ঝাঁকুনি থেকেই হেঁচকি তৈরি হয়। যা প্রতি মিনিটে কয়েকবার পর্যন্ত হতে পারে। চিকিৎসাশাস্ত্রে এটি সিনক্রোনাস ডায়াফ্রাগমাটিক ফ্লাটার বা সিংগুল্টাস নামে পরিচিত। হেঁচকির সময় শ্বাসনালীতে সামান্য খিঁচুনির মত হয়। যার ফলে শ্বাসযন্ত্রে দ্রুত বাতাস প্রবেশ করে। তখন ভোকাল কর্ড হঠাৎ বন্ধ হয়ে ‘হিঁক’ জাতীয় শব্দ তৈরি হয়।
হেঁচকি বিষয়টি রিফ্লেক্স আর্কের সাথে সম্পর্কিত। একবার উদ্দীপনা সৃষ্টি হলে রিফ্লেক্স বা প্রতিবর্তী ক্রিয়ার মাধ্যমে হঠাৎ করেই খুব জোরের সাথে ডায়াফ্রামের সংকোচন ঘটে। এর প্রায় ০.২৫ সেকেন্ড পরে ভোকাল কর্ড বন্ধ হয়। হেঁচকির ছন্দ তথা দুই হেঁচকির মধ্যবর্তী সময় ব্যবধান প্রায় স্থির থাকে।
Advertisement
হেঁচকির কারণ হতে পারে কিছু কিছু অসাবধানতা। যেমন তাড়াহুড়া করে খাবার খাওয়া হলো হেঁচকির সবচেয়ে সাধারণ কারণ। দ্রুত খাওয়ার কারণে খাবারের সাথে সাথে পেটের ভেতর বাতাস প্রবেশ করলে তথা এরোফেজিয়ার কারণে ‘ভ্যাগাস’ স্নায়ুর কার্যকলাপ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে হেঁচকি তৈরি হয়। এরোফেজিয়া ছাড়াও কাশি, গ্যাস্ট্রোইসোফ্যাজিয়াল রিফ্লাক্স বা পাকস্থলীয় খাদ্য উপাদান বা রস খাদ্যনালীতে উঠে আসা, হায়াটাস হার্নিয়া থাকলেও হেঁচকি উঠতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে পানি পান না করে থাকার পর হঠাৎ দ্রুত পানি পান করা, খাবার সময় কথা বলা বা অন্যদিকে মনোযোগ দেওয়া ইত্যাদিও হেঁচকির উল্লেখযোগ্য কারণ।
তাছাড়া জোরে হাসা, হঠাৎ ভয় পাওয়া, আবেগ, উত্তেজনা ইত্যাদি কারণেও হেঁচকি উঠতে পারে। চেতনানাশক, ওপিয়েট জাতীয় ওষুধ, উত্তেজনাবর্ধক, পার্কিনসন্স রোগ বা কেমোথেরাপির বিভিন্ন ধরনের ওষুধ সেবন, কোমলপানীয়, অ্যালকোহল, শুকনা রুটি বা কিছু কিছু মশলা জাতীয় খাবার গ্রহণ ইত্যাদির ফলেও হেঁচকি তৈরি হতে পারে। স্ট্রোক, মাল্টিপল স্কলেরোসিস, মেনিনজাইটিস, বৃক্ক বিকল, শল্যচিকিৎসার ফলে ভ্যাগাস স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, রক্তে বিবিধ লবণের তারতম্য ইত্যাদির মতো কিছু অসুখের কারণেও এটা হতে পারে। তবে কোনো ধরনের কারণ ছাড়াও হেঁচকি আসা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়।
বেশিরভাগ সময় কিছু ঘরোয়া উপায় অনুসরণ করে হেঁচকি বন্ধ করা যায়। ঘরোয়াভাবে হেঁচকি থামানোর প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে মূলত দুটি মূলনীতি অনুসরণ করা হয়। একটি হলো রক্তে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া, যেন শ্বাসনালীতে খিঁচুনি বন্ধ হয়। আরেকটি হলো শ্বাসপ্রশ্বাস ও গলাধঃকরণের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা ‘ভ্যাগাস’ স্নায়ুকে উদ্দীপ্ত করা।
এজন্য বুক ভরে শ্বাস গ্রহণ করে যতক্ষণ সম্ভব বন্ধ রেখে আস্তে আস্তে প্রশ্বাস ছাড়তে হবে। এটি করতে হবে বেশ কয়েকবার। হেঁচকি ওঠা বন্ধ না হলে বিরতি দিয়ে প্রয়োজনে বারবার এ পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। এছাড়া একটি কাগজের ব্যাগ দিয়ে মাথা ও মুখ ঢেকে শ্বাস নিতে হবে এবং ছাড়তে হবে একাধারে বেশ কয়েকবার। এক্ষেত্রে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করা উচিত নয়।
Advertisement
এতে কাজ না হলে নাক-মুখ বন্ধ রেখে নিশ্বাস ফেলতে চেষ্টা করুন, এটাকে ভালসালভা ম্যানুভার বলা হয়। কয়েকবার করা যেতে পারে এটি। দুই হাঁটু বুক পর্যন্ত টেনে ধরে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েও হেঁচকি থামানোর প্রচেষ্টা চালানো যায়। পাশাপাশি ঠান্ডা পানি কিংবা গরম দুধ পান করতে পারেন।
ঘরোয়া টোটকা হিসাবে এক চামচ চিনি জিহ্বায় নিয়ে সামান্য সময় পর গিলে খেয়ে ফেলার কিংবা লেবুতে কামড় দেওয়া বা একটু ভিনেগারের স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা করুন। এছাড়া নাক চেপে ধরে পানি পান করতে পারেন এবং গরম পানি দিয়ে গোসল করেও অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। দুই দিনের মধ্যে হেঁচকি চলে না গেলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
এসইউ/এমকেএইচ