ঢাকা শহরে যানজটের কারণে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। এতে বছরে আর্থিক ক্ষতি ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যানজটের কারণে মানসিক চাপসহ নানা ভোগান্তির শিকার হতে হয় নগরবাসীকে।
Advertisement
ক্ষতির এই তথ্যটি ২০১৮ সালে এক গবেষণা প্রতিবেদনে তুলে ধরেছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই)।
এসব সমস্যা সমাধানে ঢাকা শহরের যানবাহন ব্যবস্থাপনা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে উন্নতমানের অপারেশন ও ম্যানেজমেন্ট নিশ্চিত করার কথা বলেন এআরআই’র পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন।
এ বিষয়ে ড. মোয়াজ্জেম জাগো নিউজকে জানান, বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা ও নিম্নমানের বাসসেবা ফেলে সরকারি অর্থায়নে পরিকল্পিত মানসম্মত বাসসেবা চালু করতে হবে। মানসম্মত বাসসেবা চালুতে কোনো অবস্থায়ই বেসরকারি কোম্পানিকে যুক্ত করা যাবে না, তাহলে তারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। লেগুনা, সিএনজি, রিকশা—এ জাতীয় যান বন্ধ করতে হবে। তাহলেই কেবল রাজধানীর বিদ্যমান যানজট ও আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
Advertisement
তিনি বলেন, ‘ঢাকার যানজট নিয়ন্ত্রণে এই মুহূর্তে সরকারের যে আরবান ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (নগর পরিবহন কর্তৃপক্ষ) আছে, এটার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তাদের তত্ত্বাবধানে সরকারি নিয়ন্ত্রণে উন্নত বাস পরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এটা মোটামুটিভাবে অল্প সময়ে ও অল্প টাকায় সম্ভব। এটা অল্প টাকায় এক বছরের মধ্যেই সরকার চাইলে বাস্তবায়ন করতে পারে।’ ঢাকা শহরে যে ক্ষতি হচ্ছে, এর চেয়ে কম বা কাছাকাছি ক্ষতি হচ্ছে চট্টগ্রাম ও সিলেটের মতো বড় শহরগুলোতে। মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘এই বড় শহরগুলোয় উন্নত বাস চালুর মাধ্যমে সরকার বড় প্রভাব তৈরি করতে পারে এবং ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারে।’
সম্পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে এটা সম্ভব হবে না বলেও মনে করেন তিনি। এআরআই পরিচালক বলেন, ‘বেসরকারি কোম্পানি দিয়ে হবে না এ কারণে যে, যখনই আপনি বেসরকারি কোম্পানি অনুমতি দেবেন সেখানে ভালো-খারাপ মিলিয়ে ১০০ বা ২০০ কোম্পানি চলে আসবে। তারা তাদের রাজনৈতিক শক্তির মাধ্যমে পরিকল্পনামাফিক বাস চলাচল ব্যাহত করে। সেজন্য তাদের দিয়ে পরিকল্পিত উন্নত বাস পরিবহন ব্যবস্থা চালানো সম্ভব নয়। এটা একমাত্র সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন একটি কোম্পানির অধীনেই পরিকল্পিতভাবে, সুষ্ঠুভাবে চালানো সম্ভব। অনেক বলা হলেও পরিকল্পনার আওতায় আনা যায়নি গত ১০ বছরেও। আসলেও সম্ভব হবে না। কারণ তারা রাজনৈতিকভাবে খুব শক্তিশালী এবং তাদের শতজনের শতমত। পৃথিবীর প্রায় সব বড় শহরেই সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিবহন ব্যবস্থা পরিচালনা করে।’
সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবেই ঢাকার রাস্তায় যানজট লেগে থাকে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের
ব্যক্তিগত গাড়ির বিষয়ে মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘ব্যক্তিগত গাড়ি আসলে এখনো আমাদের ওই পর্যায়ে বাড়েনি। একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। ব্যাংককে ৪০ লাখ ব্যক্তিগত গাড়ি আছে। সেখানে ঢাকা শহরে মাত্র তিন থেকে চার লাখ প্রাইভেটকার আছে। কাজেই ঢাকায় এমন কিছু প্রাইভেটকার বেড়ে যায়নি যে, নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।’ দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল বলে ৩-৪ লাখ ব্যক্তিগত গাড়ি ম্যানেজ করা যাচ্ছে না উল্লেখ করেন এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ। ঢাকা মহানগরীতে সিএনজি, লেগুনা, রিকশার মতো ছোট যানবাহন রাখার সুযোগ নেই বলেও মনে করেন তিনি। তার বক্তব্য, ‘সিএনজি, লেগুনা, রিকশা—এ জাতীয় যানবাহন চালানো যাবে না। কারণ ঢাকা অনেক বড় শহর। এখানে এই ধরনের ছোটখাটো গাড়ি দিয়ে হবে না। বড় আকারে বাস দিয়েই এ সেবা তৈরি করতে হবে।’ ঢাকা শহরে চাইলেও রাস্তা বাড়ানো যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যেটা বাড়ানো যাবে সেটা হলো পরিকল্পিত পরিবহন ব্যবস্থা এবং উন্নতমানের অপারেশন ও ম্যানেজমেন্ট। এদিকে নজর দেয়া উচিত।’ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘রাস্তা বাড়ানো খুব বেশি জরুরি নয়। কারণ হলো হংকং ও সিঙ্গাপুরে আমাদের সমান বা আমাদের চেয়ে কম রাস্তা আছে। কিন্তু তাদের যানজট নেই।’ তিনি বলেন, ‘যানজট তৈরি করে রাখা হয়েছে বলেই এত মানুষ থাকে। যানজট কমিয়ে আনলে মানুষও দূরে সরে যাবে। ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। নরসিংদী শহর থেকে ঢাকায় এসে চাকরি করবে মানুষ। মানুষ যদি এক ঘণ্টায় নরসিংদী থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে পারে তাহলে তারা ঢাকায় থাকবে না। গাজীপুর থেকে ৪০ থেকে ৫০ মিনিটে চলে আসতে পারলে তো মানুষ গাজীপুরেই থাকবে। রাস্তাঘাট ব্লক করে রাখা হয়েছে বলেই লোকজন গাদাগাদি করে এক জায়গায় থাকছে।’
Advertisement
ইউরোপের অনেক শহরে ঢাকার চেয়ে চাপা রাস্তা আছে, সেগুলো দিয়েই অনেক বড় বড় বাস চলছে। সেখানে যানজট নেই বলে দাবি এআরআই পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেনের। পিডি/জেডএইচ/এসএইচএস/এইচএ/জিকেএস