কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না রাজধানীর গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য। সরকারি কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) নির্ধারিত চার্টের তোয়াক্কা না করে বাসগুলো চলছে তাদের নিজেদের আবিষ্কৃত এক বিশেষ পদ্ধতিতে। যাত্রীদের পকেট কাটার এই পদ্ধতির নাম ‘ওয়েবিল’। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট দূরত্বের জন্য কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া দেয়ার কথা থাকলেও বাস মালিকদের স্বেচ্ছাচারী ব্যবস্থায় যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে দ্বিগুণ-তিনগুণ পর্যন্ত ভাড়া।
Advertisement
যাত্রী ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এ পদ্ধতিতে দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে যাত্রীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। প্রতি মুহূর্তেই সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষিত হলেও ভ্রূক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষের।
ভাড়া বেশি আদায়ের জন্য বাস মালিকরা দিয়েছেন গালভরা ‘সিটিং সার্ভিস’ নাম। কথিত এই সিটিং সার্ভিসের বাসগুলোতে নির্ধারিত দূরত্বের পরপর কতজন যাত্রী উঠেছেন, তা গণনা করে যে খাতায় লেখা হয় সেটাই ওয়েবিল।
কয়েকটি স্টপেজ পরপর এই কাজটি করেন একজন লাইনম্যান। একজন লাইনম্যান নির্ধারিত দূরত্বে ওয়েবিলে যাত্রীর সংখ্যা লিখে দেন। এক ওয়েবিলের স্টপেজ থেকে পরবর্তী স্টপেজের মধ্যে যেখানেই নামুন না কেন, যাত্রীকে গুনতে হয় পুরো পথের ভাড়া। এখানে কিলোমিটারপ্রতি সরকারি হিসাবের কোনো বালাই নেই।
Advertisement
জানতে চাইলে পরিবহন শ্রমিকরা বলেন, ‘এইটা ওয়েবিলের গাড়ি।’
রাজধানীর বিভিন্ন রুটে নিয়মিত চলাচলকারী যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানী থেকে লোকাল বাস প্রায় ‘হারিয়ে গেছে’। পরিবর্তে রাস্তায় নেমেছে কথিত ‘সিটিং সার্ভিস’। কিন্তু এই সার্ভিস কেবল ভাড়া আদায়ের বেলায়ই প্রযোজ্য। তাদের সার্ভিস লোকালের মতোই। যত্রতত্র আর দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলা হলেও ওয়েবিলের দোহাই দিয়ে আদায় করা হয় অতিরিক্ত ভাড়া।
ভাড়া নিয়ে বাসগুলোর এসব নৈরাজ্য আর যাত্রীদের অভিযোগের বিষয়টি যাচাই করতে জাগো নিউজের প্রতিবেদক কয়েকটি রুটের বাসে চড়েছেন।
এই অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ বাসেই নেই বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়ার চার্ট। এ নিয়ে চালক, শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতিনিয়তই যাত্রীদের বচসা, হাতাহাতির ঘটনা ঘটছে। ২০১৬ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ঢাকার বাস ও মিনিবাসের নির্ধারিত ভাড়া ছিল কিলোমিটারপ্রতি এক টাকা ৭০ পয়সা। তবে সেই নিয়মের তোয়াক্কা করছে না কোনো বাসই।
Advertisement
মিরপুর-১২ থেকে গুলিস্তান রুটে চলাচল করে বিহঙ্গ, শিকড় ও বিকল্প পরিবহন নামে তিনটি বাস। এগুলোর প্রত্যেকটিতেই দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলা হলেও ভাড়া রাখা হয় কথিত সিটিং সার্ভিসের মতোই।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অতুল বলেন, ‘মিরপুর থেকে ফার্মগেট গেলেও ১৫ টাকা ভাড়া আবার তার অনেক আগে শেওড়াপাড়া বা তালতলা নেমে গেলেও ১৫ টাকা ভাড়া। একইভাবে মিরপুর থেকে মতিঝিল, গুলিস্তানের ভাড়া ২৫ টাকা। কিন্তু তার আগে অর্থাৎ শাহবাগ বা পরীবাগে নামলেও একই ভাড়া দিতে হয়। এ কেমন জুলুম?’
গুগল ম্যাপে দেখায় মিরপুর-১২ বাসস্ট্যান্ড থেকে কাজীপাড়ার দূরত্ব ৪ দশমিক ২ কিলোমিটার এবং ফার্মগেট বাস স্টপেজের দূরত্ব প্রায় ৯ কিলোমিটার। বিআরটিএ নির্ধারিত রেট অনুযায়ী মিরপুর-১২ থেকে কাজীপাড়ায় ভাড়া আসে ৬ টাকা ৮০ পয়সা এবং ফার্মগেটে ১৫ টাকা।
কিন্তু এ রুটে চলাচলকারী বাসগুলোতে উঠে কাজীপাড়ায় নামলেও গুনতে হয় ফার্মগেটের ভাড়া অর্থাৎ ১৫ টাকা।
এছাড়া, যাত্রী ঠকাতে ওয়েবিল চেকপয়েন্ট রাখা হয় এমন জায়গায়, যাতে মাঝপথে নেমে যাওয়া যাত্রীর কাছ থেকেও আদায় করা যায় পুরো ভাড়া।
মিরপুর, গাবতলী, মোহাম্মদপুর বা মহাখালী হয়ে আসা বাসগুলো ওয়েবিল চেকপয়েন্ট বসিয়েছে ফার্মগেটের পর। দেখা গেছে, ফার্মগেট থেকে হোটেল সোনারগাঁও (শাহবাগের আগের মোড়) পর্যন্ত ওয়েবিলের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ টাকা। এর মধ্যে যে কোনো জায়গায় যেতে চাইলে পুরো টাকাটাই দিতে হয় যাত্রীদের। কেউ শাহবাগে গেলে নেয়া হয় ২৫ টাকা। অথচ ২৫ টাকা ভাড়া ফুলবাড়িয়া বা গুলিস্তান পর্যন্ত।
যাত্রী অধিকার আন্দোলনে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মূলত যাত্রীদের কাছ থেকে কৌশলে পুরো ভাড়া আদায়ের জন্যই এই ওয়েবিল চেকপয়েন্ট ব্যবস্থার প্রবর্তন।
দেখা গেছে, ওয়েবিল চেকপয়েন্টগুলো যেসব জায়গায় বসানো হয়েছে সেসব জায়গায় যাত্রীরা সাধারণত কম নামেন। চেকপয়েন্টগুলো দেখা গেছে ফার্মগেটের বদলে কারওয়ান বাজারে, শাহবাগের বদলে পরীবাগে, বাংলামোটরের বদলে সোনারগাঁও হোটেলের পাশে এবং মগবাজারের বদলে সাতরাস্তায়।
গুলশান-বাড্ডা লিংক রোডের বাসযাত্রী শারমিন জানান, রামপুরা থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রুটে চলাচলকারী স্বাধীন, রমজান, রাজধানী পরিবহনে স্টাফ কোয়ার্টার থেকে রামপুরা পর্যন্ত ভাড়া নেয় ২০ টাকা। মাঝপথে যেখানেই নামা হোক না কেন, ওয়েবিলের কথা বলে ১০ টাকার নিচে ভাড়া নিতে চায় না।
মিরপুরের কালশী হয়ে উত্তরা, বনানী, গুলশান, রামপুরা রুটের বাসগুলোতেও একইভাবে যাত্রীদের জিম্মি করে চলছে হয়রানি। প্রজাপতি, পরীস্থান, তুর, রবরব, অছিম পরিবহনসহ বিভিন্ন রুটের গাড়িতে উঠলেই যাত্রীদের দিতে হচ্ছে পুরো ভাড়া।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নওশাদের মতে, ‘এই রুটে হরিলুট চলছে। যেখান থেকে ওঠেন যেখানেই নামবেন, আপনাকে দিতে হবে পুরো ভাড়া। বাসভেদে যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে ২৫ থেকে ৪০ টাকা।’
একই ভাবে যাত্রাবাড়ী বা সদরঘাট থেকে গাজীপুর বা আব্দুল্লাহপুর রুটে চলাচলকারী আকাশ (সুপ্রভাত), ভিক্টর ক্ল্যাসিক, রাইদাও কাটছে যাত্রীর পকেট। এসব বাসে উঠলেই ১০ টাকা গুনতে হয়, এবার যাত্রী যত কম দূরত্বের গন্তব্যেই নামেন না কেন।
বাসচালক ও হেলপাররা জানান, বাসগুলো দিনভিত্তিক চুক্তিতে চলে যাওয়ায় ওয়েবিল সিস্টেমে চলে গেছেন মালিকরা। এতে মালিক, চালক, হেলপার—সবার পকেটেই ভালো টাকা আসছে।
বিহঙ্গ পরিবহনের এক চালক জানান, ‘দৈনিক সাড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকার চুক্তিতে গাড়ি চালাতে হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ‘বখশিস’ দিতে হয়। এছাড়া তেল খরচ, হেলপারের বেতন আছে। দিনে তিন থেকে চারটি ট্রিপ দেয়া যায়। প্রতি ট্রিপে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া তোলা যায়। তাই ওয়েবিলে না চালালে এখন আর পোষায় না।’
যাত্রীদের অভিযোগ, বাড়তি ভাড়া আদায় ও অন্য বাসের আগে যাত্রী ধরতে প্রায়ই বেপরোয়া হয়ে ওঠে বাসগুলো। এতে বাসে বাসে সংঘর্ষ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে শ্রমিকদের বাগবিতণ্ডা তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক প্রকার নৈরাজ্য চলছে গণপরিবহনে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভাড়া নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে বিআরটিএ সাংবিধানিকভাবে দায়বদ্ধ। আমরা দেখি ভাড়া নির্ধারিত হয় কিলোমিটার হিসেবে। কিন্তু রাস্তায় ভাড়া আদায় হয় কথিত ওয়েবিল হিসেবে। শেষ গন্তব্য পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সব যাত্রীকেই দিতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘ওয়েবিলে ভাড়া আদায় নিয়ে বিআরটিএ কিন্তু নীরব। তাদের মোবাইল কোর্টকেও আমরা মাঠে দেখি না। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখিনি।’
‘আমরা মনে করি বিআরটিএ জনগণের প্রতিষ্ঠান হলেও তারা পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের স্বার্থে কাজ করছে। ফলে জনগণ ভাড়া নৈরাজ্যের শিকার হচ্ছে’—বলেন মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
তবে যাত্রীদের এসব অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করেন বাংলাদেশ পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘ওয়েবিলে ভাড়া বেশি রাখার কোনো সুযোগ নেই। যারা বেশি রাখছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।’
এসএম/এসএস/এসএইচএস/এইচএ/জিকেএস