বিশেষ প্রতিবেদন

রাইড শেয়ারিংয়ে এখনো কাটেনি করোনার ধকল

হাতিরঝিল সংলগ্ন গুদারাঘাট মোড়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন মাসুদ, আলী ও আলামীন। এর মধ্যে মাসুদ মোটরসাইকেলের ওপর বসে ছিলেন। তাকে ঘিরে ছিলেন আলী ও আলামীন। প্রতিদিনই তারা কাজের ফাঁকে এখানে আড্ডা দেন। পাঁচ-সাত মিনিট আড্ডা দেয়ার পর যে যার মতো নিজেদের মোটরসাইকেলের কাছে চলে যান। পরিচয় দিয়ে কথা বলতেই জানা গেল, তারা রাজধানীতে রাইড শেয়ারিং করেন।

Advertisement

রাজধানী ঘুরে অন্তত ১০ জন রাইড শেয়ারচালকের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, করোনার আগে মানুষের অবস্থা ভালো ছিল, বেশি পথের রাস্তায় নিয়ে গেলে ১০-২০ টাকা বাড়তি চাইলেই দিতেন। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। অনেক সময় যাত্রীদের সুবিধামতো ভাড়ায় যেতে চাইলেও যেতে চান না। যাত্রীদের অবস্থাও তো এখন ভালো না। আমরা রাইড শেয়ার বাদ দিয়েও তো কিছু করতে পারছি না।

মাসুদ, আলী, আলামীনদের কথায় বোঝা যায়, এখনো তাদের জীবনে করোনার ধকল কাটেনি। তবে শুধু তাদেরই না, নিম্ন-মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীও করোনার কারণে বেশ কষ্টে আছে বলে বোঝেন তারা। তবে তারা ভালো সময়ের আশায় আছেন।

আলীর পুরো নাম মোহাম্মদ আলী। দেশের বাইরে ছিলেন। ফেরার পর সিরাজগঞ্জে নিজ গ্রামে কাপড় বিক্রি করতেন। এর মধ্যে বিয়েও করেন। পরে ঢাকায় আসেন। পড়াশোনায় বেশিদূর যেতে পারেননি বিধায় কোনো কাজের সুযোগ না পেয়ে নিজের মোটরসাইকেল নিয়ে রাইড শেয়ারিংয়ের জন্য (পাঠাও এবং উবারের রাইড শেয়ার) নিবন্ধন করেন। করোনার আগে দিনশেষে গাড়ির তেল ও হাত খরচ বাদ দিয়ে এক থেকে দেড় হাজার টাকা থাকতো। করোনার কারণে লকডাউনের সময় তিনি গ্রামের বাড়ি চলে যান। পরে আবার ঢাকায় আসেন এবং রাইড শেয়ারও করছেন এখন।

Advertisement

আলী জানান, এখন দিনে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় হয়। তাও প্রতিদিন হয় না। তাই মাসে যা আয় হয় সেই ভরসায় গ্রাম থেকে পরিবার নিয়ে আসতে পারছেন না।

কেমন আয় হয় জিজ্ঞাসা করতেই আলামীন বলেন, ‘ভাই এখানে বসে আছি যাত্রীর জন্য, কিন্তু দেখেন, কয়জন আসে। গেলেও তো সেখান থেকে খালি বাইক নিয়ে আসতে হয়।’ এ কথা বলেই পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ৪৫০ টাকা গুণে দেখালেন। বললেন, ‘সকাল ৮টায় বের হয়েছি, দুপুরে খেয়েছি আবার রাতে খাব। তাহলে কয় টাকা থাকে? আবার তেলও কিনতে হবে।’

রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোর নির্ধারিত টাকা পরিশোধের বাধ্যবাধকতার জন্য রাজধানীতে অনেকেই যাত্রীদের সঙ্গে চুক্তি করে রাইড শেয়ার করেন। তাদেরই একজন হেলাল। পল্টন এলাকার বিজয়নগর পানির ট্যাংকের কাছে দাঁড়াতেই তিনি বলেন, ‘ভাই কোথায় যাবেন?’ পরিচয় দিয়ে সারাদিনে কেমন রাইড শেয়ার হয়েছে জানতে চাইলে বলেন, ‘করোনার কারণে মানুষের হাতের অবস্থা ভালো না। যাদের অবস্থা ভালো ছিল তারাও কঠিন সময় পার করছেন। বাসে যেখানে যাওয়া যায় সেখানে এখন মানুষ বাসেই যাচ্ছেন। যাদের দ্রুত যাওয়া প্রয়োজন তখন হয়তো মোটরসাইকেলে রাইড নিচ্ছেন। আবার চুক্তি করলেও ভাড়া কম দিতে চান। আমরাও এ সময়ে যাত্রীর অবস্থা বুঝে তাদের পছন্দমতো ভাড়ায়ই গন্তব্যে যাচ্ছি। আসলে কী বলবো ভাই, আমরা চাইলেই তো আর যা কিছু করতে পারি না। রাইড শেয়ারই করছি, আল্লাহ সেভাবেই চালিয়ে নিচ্ছেন।’

কারওয়ানবাজার পেট্রোবাংলা ভবনের সামনে এক বেসরকারি চাকরিজীবী মোটরসাইকেল চালকের সঙ্গে কথা হয়। অফিস শেষে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত রাইড শেয়ার করেন। তিনি বলেন, ‘সবাই তো মোটরসাইকেলে ওঠেন না। আবার আমরাও সময়-সুযোগ বুঝে যাত্রী নিতে পারি না। চাকরি করে চলতে পারি না বলেই এই কাজ করি। যেটুকু হয় সেটুকুই ভালো। তবে মানুষের আয়-উপার্জন আর চাকরি না থাকায় আমরা যাত্রী পাচ্ছি না। বুঝি তো, করোনা কত বড় বিপদ ডেকে আনছে। বেকার হয়ে গেছেন অনেক মানুষ, কারও কাছে হাত পাততে পারছেন না। মোটরসাইকেলও তো শহরে কম নয়, কয়জনইবা মোটরসাইকেলে যেতে পারেন। এখন পর্যন্ত দুই ট্রিপে পাইছি ১৬০ টাকা। রাত হয়ে গেছে, এখন বাড়ি ফিরতে হবে।’

Advertisement

রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান পাঠাও-এর পরিচালক সৈয়দা নাবিলা মাহবুব বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তো আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাভাবিক হচ্ছি, ভ্যাকসিনও চলে আসছে। লকডাউন সময়ের চেয়ে এখন আমাদের রাইড শেয়ারও স্বাভাবিক হচ্ছে। আগামীতে পরিস্থিতি পুরোপুরি ভালো হলে আরও রাইড শেয়ার বাড়বে বলে মনে করছি।

এওয়াইএইচ/ইএ/এসএইচএস/এইচএ/জেআইএম