রাজধানীর শান্তিনগর থেকে গৃহিণী রাবেয়া ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের বাসে ওঠার অপেক্ষায়। যাবেন কোর্ট এলাকায় (জনসন রোড)। তিনি ওঠার আগে হেলপারকে জিজ্ঞেস করলেন, সিট আছে কি-না? ‘হ্যাঁ’ বলতেই তিনি বাসে উঠে পড়লেন। বাসে ওঠার পর দেখলেন সংরক্ষিত নয়টি আসনের (সিট) একটিও ফাঁকা নেই। এর মাঝে একটি আসনে একজন পুরুষ বসে আছেন। পাশ থেকে ড্রাইভার বললেন, ‘ভাই উঠে যান, ওই আপা বসবে।’
Advertisement
এদিকে ওই নারী যাত্রী হাতে একগোছা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাসভর্তি যাত্রী নিজেদের মতো বসে আছে। নারী সিটে বসে থাকা অন্যরা ওই পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘আপনি এখানে বসছেন কেন?’ জবাবে উচ্চকণ্ঠে পুরুষ যাত্রী বলে উঠলেন, ‘আপনাদের বলতে হবে আমি কেন বসেছি?’ তখন নারী যাত্রীরা বলেন, ‘আপনি দেখছেন না, এখানে লেখা এই নয়টি সিট নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য, তাহলে আপনার বসা কি ঠিক হয়েছে?’ কথার জবাবে পুরুষ যাত্রী বললেন, ‘লেখা থাকলেই তো সিট পাওয়া যায় না! দেশে তো সবকিছুরই আইন আছে, বাস্তবায়ন আছে?’
পরে নারী যাত্রী, হেলপার, সুপারভাইজার ওই যাত্রীকে অনুরোধ করলেও তিনি সিট ছাড়েননি। বরং বলতে থাকেন, ‘আমি তো আগে এখানে বসেছি, এখন এই ভিড়ের মধ্যে সিট ছেড়ে দিয়ে আমি কি দাঁড়িয়ে থাকবো?’ এমন তর্কাতর্কির মধ্যে সাধারণ আসনের এক পুরুষ যাত্রী উঠে গিয়ে ওই নারীকে বসার অনুরোধ করেন। যদিও এরই মধ্যে নারী আসনও ফাঁকা হয়, যেজন্য তাকে ওই পুরুষ যাত্রীর আসনে বসতে হয়নি। তবে সেই পুরুষ যাত্রী আসনট ছাড়লেন না।
শুধু এই একটি ঘটনাই নয়, রাজধানীর বিভিন্ন গণপরিবহনে নারী যাত্রীদের আসনে বসা নিয়ে হরহামেশা এমনই ভোগান্তির শিকার হতে হয়। দেখা যায়, নারীর জন্য সংরক্ষিত আসনে পুরুষ যাত্রী বসে আছেন। কিছু বললেও তারা কর্ণপাত করেন না। এতে অনেকে বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েই গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করেন। যদিও কিছু পুরুষ যাত্রীকে অনুরোধ করলে তারা আসন ছেড়ে দেন।
Advertisement
অবশ্য দেশের বহুল আলোচিত ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-তে গণপরিবহনে মহিলা, শিশু, প্রতিবন্ধী এবং বয়োজ্যেষ্ঠ যাত্রীর জন্য সংরক্ষিত আসনে অন্য কোনো যাত্রী বসলে এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান উল্লেখ রয়েছে। আইনটি ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়। অথচ আইনের এই বিধান সম্পর্কে গণপরিবহনের যাত্রীসহ বাসের হেলপার, চালক কারোরই সঠিক ধারণা নেই।
চালকদের একজনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আইন তো আছে শুনছি কিন্তু যাত্রীরা তো সচেতন নয়।’ আইনে নারী আসনে পুরুষ যাত্রী বসলে শাস্তির বিধান কী, জানতে চাইলে তিনি জানান, সঠিক ধারণা নেই।
বাসের এক হেলপারকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘যাত্রীদের বলার পরও শুনতে চায় না। আবার অনেকে নিজে থেকেই নারী যাত্রী দেখলে উঠে যান। তাই আমার কাছে মনে হয়, নারী যাত্রীদের সিটে বসার অধিকারকে যদি পুরুষরা সহজভাবে মেনে নেয় তাহলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।’
পল্টন মোড়ে বাসের জন্য অপেক্ষারত বেসরকারি চাকরিজীবী শারমিন আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘বেশ কিছুক্ষণ ধরে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। যে ভিড় উঠতেই ইচ্ছা করছে না। বাসে উঠলে তো আর সিট পাওয়া যায় না। উত্তরা যাওয়ার পথও তো কম নয়।’
Advertisement
আক্ষেপ করে বলেন, ‘কিছু পুরুষ যাত্রী আছেন, যারা নারীদের সিটে বসে পড়েন। বলার পরও উঠতে চান না। বাসের ড্রাইভার, হেলপার ও সুপারভাইজার বললেও তারা শুনতে কিংবা মানতে চান না। মনে হয়, জোর করেই তারা নারীদের সিটে বসে থাকবেন। সত্যিই এটা ভাবতেই নিজের কষ্ট হয়।’
নারী যাত্রীর আসনে পুরুষের বসার শাস্তির বিধান সম্পর্কে জানতে চাইলে শারমিন আক্তার বলেন, ‘আমি আসলে জানতাম না। আপনার কাছ থেকেই শুনলাম। তবে আইনের চেয়েও বেশি প্রয়োজন সচেতনতা ও আন্তরিকতা। কেননা আমরা এ বিষয়ে জানি না। এজন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পক্ষ থেকে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। আবার কেউ জানলেও মানে না, সেক্ষেত্রে আইনের প্রতি আন্তরিক হওয়ার বিকল্প নেই।’
শারমিন মনে করেন, যারা ইচ্ছা করেই নারী যাত্রীর সিটে বসার চেষ্টা করেন তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ আইনের প্রয়োগ হতে হবে। তবেই আশা করা যায়, গণপরিবহনে নারীদের সিটে বসা নিয়ে ভোগান্তি ও বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হবে না।
জানতে চাইলে নারী অধিকারকর্মী ও ‘আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট’র নির্বাহী সমন্বয়কারী জিনাত আরা হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাসে যতগুলো সিট আছে সেগুলোতে সমানভাবে নারী-পুরুষের বসার সুযোগ আছে। যে কয়টি বিশেষ সিটের উল্লেখ রয়েছে সেগুলোতে নারীরাই বসবে। কিন্তু আমরা খেয়াল করলে দেখব, একটি বাসে যেন ওই নয়টি আসনেই নারীরা বসতে পারবেন, এ বিষয়টি ঠিক নয়। এজন্য যাত্রীসহ বাসের চালক-হেলপারকে আগে সচেতন হতে হবে এবং বাসচালকদের বিষয়টি তদারকি করতে হবে। তাহলে নারীর সিটে বসা নিয়ে ভোগান্তি হবে না বলে মনে করছি।’
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে প্রতিনিয়ত বাসচালক-হেলপারদের নির্দেশনা দিয়ে থাকি। কিন্তু দেখা যায় পুরুষ যাত্রীরা অনেক সময় মানতে চান না, আবার নারী যাত্রীর সিটেই বসে থাকেন। এ বিষয়টি সমাধানে বাসচালক-হেলপারসহ পুরুষ যাত্রীদের সচেতন হতে হবে।’
এওয়াইএইচ/এসএইচএস/এইচএ/জেআইএম