মতামত

বেগম আশরাফুন্নিসা : নয়জন বীর মুক্তিযোদ্ধার গর্বিত মা

বেগম আশরাফুন্নিসা নয়জন বীর মুক্তিযোদ্ধার জননী। তাঁর সাত পুত্র এবং দুই কন্যা বীর মুক্তিযোদ্ধা। এই নয়জনের মধ্যে চারজন মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতার জন্য বীরত্বসূচক পদকের অধিকারী। কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম, এক সন্তান-বেলাল ও বাহার ইউসুফ বীরবিক্রম, দুই সন্তান বীরপ্রতীক। এই বীরপ্রতীক এরা পেয়েছেন দু’বার করে। তিনি নোয়াখালীর দক্ষিণ জয়পুরের মেয়ে। বাবা মো. ইউনুস মিয়া ছিলেন আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের বড় কর্মকর্তা। তাঁর দুই মেয়ে। আশরাফুন্নিসা ও ছোট মেয়ে মরিয়ামুন্নিসা। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন মরিয়ামুন্নিসারই মেয়ে। স্বামী মহিউদ্দিন আহমেদের বাড়ি বৃহত্তর ময়মনসিংহের (বর্তমান নেত্রকোনা) পূর্বধলা থানার কাজলা গ্রামে। মহিউদ্দিন আহমেদ পড়াশোনা করেছেন আনন্দমোহন কলেজে। ডিস্টিংশান নিয়ে এন্ট্রান্স (এসএসসি সমমান) পাস করেছিলেন।

Advertisement

তবে অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়ায় পড়াশোনা শেষ না করেই রেলের চাকরিতে যোগ দিতে হয়েছিল। আসামের বদরপুর রেলস্টেশনে চাকরিকালীন আশরাফুন্নিসার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের ১১ সন্তানের মধ্যে কর্নেল আবু তাহের তৃতীয়। আট ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে এক ছেলে সন্তান—ঝন্টু পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালীন মারা যায়। বাকি ১০ সন্তানকে শুধু লেখাপড়া নয়, উদ্যমী ও সাহসী করে গড়ে তুলেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তাঁর সন্তানরা মুক্তিযুদ্ধে কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম জীবনপণ যুদ্ধ করেন, চার সন্তান বীরত্বসূচক খেতাব লাভ করেন।

ছোটখাটো শ্যামলা রঙের আটপৌরে মহিলা যাঁকে কেন্দ্র করে আবর্তিত তাঁর ১১ সন্তান আর স্বামী। এক সন্তানের অকাল মৃত্যুর পর বাকি ১০ সন্তানকে নিয়ে তাঁর জীবনযুদ্ধ। ১০ সন্তানের একটি সংসার রীতিমতো একটা প্রতিষ্ঠানের মতো করে গড়ে তোলেন আশরাফুন্নিসা। স্টেশনমাস্টার স্বামী নীরবে নিঃশব্দে স্ত্রীর সকল কর্মযজ্ঞের সমর্থক ছিলেন। যিনি সন্তানদের গড়ে তুলেছেন আত্মনির্ভরশীলতা আর দেশপ্রেমের মন্ত্র দিয়ে। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা প্রশিক্ষণ, প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ, সংসারের কায়িক শ্রমে অভ্যস্ততা—এসব প্রস্তুতি শৈশব থেকে সন্তানদের দিয়েছে বৃত্ত ভাঙার সাহস।

‘আমাদের জীবন শুধু আমাদের নিজের জন্য নয়, এ জীবনের ওপর দাবি আছে আশেপাশের চেনা-অচেনা মানুষেরও’— আশরাফুন্নিসা, তাঁর এ বিশ্বাস, ছেলেমেয়েদের মধ্যে সঞ্চালিত করেছেন বারবার। তিনি ছেলেমেয়েদের ভেতরে বোধ তৈরি করেছেন মানুষের কল্যাণের দিকে, সাধারণ মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখের দিকে। এমন একটা বোধ এরা যেন কেউ একা নয়, পুরো পরিবার মিলে যেন একটা যৌথ ব্যক্তিত্ব। পরিবারের সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধে, একত্রে নেমে পড়েছে দুর্ধর্ষ বিপ্লবে আর সবার ভেতরে আলো জ্বালিয়েছেন মা আশরাফুন্নিসা।

Advertisement

২০১০ সালের ২ আগস্ট সাক্ষাৎকারেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিভাগের ডিন ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে ঘিরে তাঁদের সকল কাজের প্রেরণাদায়ী মা আশরাফুন্নিসার কথা। মেজ বউ লুৎফাতাহের, সন্তান ডালিয়ার গল্প শুনে বিস্মিত হয়ে ভেবেছি সন্তানদের কীভাবে তিনি প্রতিষ্ঠানের মতো করে বড় করে তুলেছেন। প্রদীপ্ত করেছেন আত্মবিশ্বাস, দেশের প্রতি দায়িত্ব আর মমতায়। নিজ সন্তানদেরই শুধু নয়, যুদ্ধ চলাকালীন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশ্রিত ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে গ্রামে চালু করেছিলেন বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র। প্রতিদিনের সংসারে থেকে সাধারণ একজন মা পিঠাপিঠি ১০ সন্তানকে গড়ে তোলেন স্বতন্ত্র, স্বাধীন, দায়িত্বশীল সংগঠক আর দেশপ্রেমের প্রেয়ণায়। বীরউত্তম সেক্টর কমান্ডার আর তিন বীরউত্তম-বীরপ্রতীক সন্তানসহ ৯ সন্তানই একাত্তরে রণাঙ্গনে অমিততেজে যুদ্ধ করেছেন ১১ নম্বর সেক্টরের ব্রাদার্স প্লাটুনে। আশরাফুন্নিসার সন্তানরা—কর্নেল তাহের, সেক্টর কমান্ডার-১১, বীরউত্তম, আবু ইউসুফ বীরবিক্রম, মো. ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল-বীরপ্রতীক, মো. সাখাওয়াত হোসেন বাহার-বীরপ্রতীক, আবু সাঈদ, আনোয়ার হোসেন, ডালিয়া আর জুলিয়া।

সেক্টর কমান্ডার, বীরউত্তম সন্তান কর্নেল তাহের আমৃত্যু যোদ্ধা, যিনি যুদ্ধ-পরবর্তী সময়েও তৃতীয় বিশ্বের সেনাবাহিনীকে গণমুখী করার চেষ্টায় যুদ্ধ করেছেন স্বাধীন দেশে। দেশ আর মায়ের ভালোবাসায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভয়ভীতি উপেক্ষা করে রাতের অন্ধকারে নজরবন্দি তাহের দেশকে মুক্ত করার সংকল্প নিয়ে পাকিস্তান সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছান। দায়িত্ব নেন শেরপুর বকশীগঞ্জ, জামালপুর, রৌমারীসহ বিশাল আয়তনের ১১নং সেক্টরের।

১১নং সেক্টরের দায়িত্ব নেওয়ার পর চিলমারী অপারেশনের সাফল্য কর্নেল তাহেরকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। কামালপুর হয়ে দাঁড়ায় তাঁর পরবর্তী অন্যতম টার্গেট। কামালপুর ঘাঁটিকে দখল করার নানা পরিকল্পনা করতে থাকেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় এক মাস পূর্বে ১৪ নভেম্বর ভোররাতে অপারেশন শুরু করেন। সেদিনের অপারেশনে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার সাথে উপস্থিত ছিলেন তাহেরের পুরো পরিবার। দুই সন্তান বেলাল, বাহার, তাঁদের স্কাউট টিম নিয়ে থাকতেন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পজিশনে।

ছেলে আবু ইউসুফ ও ছেলে আনোয়ার, মেয়ে ডালিয়াও উপস্থিত ছিলেন কামালপুর যুদ্ধক্ষেত্রে। তিনটা রেঞ্জে একই সঙ্গে চলে তুমুল ফায়ার। এমএমজি, ভারী মেশিনগানের বিকট শব্দ আর আগুনের হলকায় ছেয়ে যায় কামালপুর, ধানুয়া কামালপুর, উঠানিপাড়া, হাসিরগাঁওয়ের রাতের আকাশ, বাতাস। সকালের দিকে কামালপুরের অনেকটা ভেতরে ঢুকে পড়ে মুক্তিবাহিনী। ভয়াবহ গোলাগুলির মধ্যে পড়ে একই সাথে পাকিস্তানি বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধা উভয়ই নিহত হচ্ছে একের পর এক। উঁচু ঢিবিতে বসে থাকা তাহের নামতে উদ্যত হওয়ার মুহূর্তেই সেখানে একটি শেল ড্রপ হয়। মর্টারের শেলের আঘাতে একটি পা হারিয়েও রক্তাক্ত কমান্ডার তাহের সহযোদ্ধাদের বলেন, ‘যুদ্ধ চালিয়ে যাও, তোমরা ফ্রন্টে ফিরে যাও, যুদ্ধ চালিয়ে যাও... মনে রেখ কামালপুরকে মুক্ত করতে হবে। আমি মরবো না, খুব দ্রুত চলে আসছি তোমাদের কাছে। পাকিস্তানিদের তোমাদের হারাতেই হবে।’ এই দৃঢ় মানসিকতা আত্মপ্রত্যয় সম্ভব হয়েছিল মা আশরাফুন্নিসার প্রত্যক্ষ সমর্থন ও শিক্ষণের ফলে। দেশের প্রতি, মাটির প্রতি, ভালোবাসার ঋণ শোধ করেন তাঁর সন্তানেরা জীবন দিয়ে। লাতিন আমেরিকার নোবেল বিজয়ী গাব্রেরিয়াল গার্সিয়া মার্কেজের বুয়েন্দিয়া পরিবারের মতো মা আশরাফুন্নিসার সন্তানরা অপূর্ব বীরত্ব, বিপ্লব ও দুর্জয় সাহসিকতায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করবে, দেশপ্রেম উৎসারিতহবেআমাদেরগভীরে।

Advertisement

গড়ন ছোটখাটো, রঙ শ্যামলা—যেনপলিমাটির এই বাংলাদেশের অকৃত্রিম একজন মা আশরাফুন্নিসার ছেলেমেয়েদের সাহস ও উদ্যম দিয়ে গড়ে তোলার একটি বাসনা ছিল শুরু থেকেই। তাই তাঁর সন্তানরা শৈশব থেকেই নতুন কিছু করার প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ বোধ করতো। বড় মেয়ে শেলীর লেখাপড়ার প্রতি আশরাফুন্নিসা ও স্বামীর মনোযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। মেয়েদের সেরা সব স্কুল, যেমন- সিলেটের সরকারি গার্লস স্কুল, চট্টগ্রামের খাস্তগীর গার্লস স্কুল এবং ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী স্কুল ও পরে মমিনুন্নেসা কলেজে শেলী লেখাপড়া করেন। ওই কলেজের ছাত্রী সংসদের ভিপি ছিলেন তিনি। সেই সময় শেলী শুধু ছাত্র ইউনিয়নেরই নেত্রী ছিলেন না, নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ অঞ্চলে সক্রিয় গোপন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দের সাথেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। এসব কাজে আশরাফুন্নিসা ও তাঁর স্বামীর সায় ছিল। পাকিস্তান আমলে ওই নেতৃবৃন্দের অনেকে তাঁদের রেলের ছোট কোয়ার্টারে এসে থাকতেন। তিনি নিজ হাতে তাদের খাওয়াতেন, দেশের নানা বিষয় নিয়ে কথাও বলতেন। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে তাদের ছোট সন্তানদের ওপর।

ছেলেমেয়েদের মধ্যে তৃতীয় হলেও তাহেরই ছিলেন সেই পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। স্কুলজীবন থেকেই তিনি বিপ্লবী রাজনীতির সাথে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। সিলেটের এমসি কলেজে পড়ার সময় তা আরও পরিণত হয়। ছুটি শেষে কলেজ হোস্টেলে যাওয়ার আগে মা আশরাফুন্নিসা তাহেরকে বলে দিতেন ‘আউট বই’ আনার জন্য। বাড়িতে কোনো কাজের মানুষও রাখা হতো না। এতগুলো ছেলেমেয়ের ভাবনা-চিন্তা, সংসারের কাজ—এসব সামলে বই পড়ার সময় বের করতেন তিনি। ভাগনা দিহীর মাঠ এ বইটিতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধু ও কানহুর বীরত্বগাথা, জীবনদান তাঁর মনেও গভীর ভাবাবেগের সৃষ্টি করতো। মা বলতেন, ছোটবেলা থেকেই তাহের ছিলেন খুবই সাহসী। তাহের পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন পূর্ববাংলার স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য সামনে রেখেই। একটি জনযুদ্ধের মধ্য দিয়েই আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে, এই প্রতীতি তাঁর ছিল।

ছুটিতে এলেই ছোট ভাইবোনদের শেখাতেন প্যারাকমান্ডো পিটি, গেরিলা যুদ্ধের নানা কৌশল। মা আশরাফুন্নিসা মোড়ায় বসে সেসব দেখতেন। ১৯৭১-এ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার প্রস্তুতি গ্রহণকালে তাহের কাজলার গ্রামের বাড়িতে মাকে ডাকে একটি চিঠি পাঠান। চিঠিটি ‘একাত্তরের চিঠি’ বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণওইচিঠিতেনানাকরণীয়সম্পর্কেতিনিইঙ্গিতেলেখেন।তারকিছুঅংশ—গ্রামেযাআছে, তা নিয়েই আপনাদের বাঁচতে হবে। আশা করি সে মতোই আপনারা ভেবে চলবেন। কবে পর্যন্ত যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে বলা যায় না। আজকাল অবশ্য আপনাদের বিশেষ কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। মাছ পাওয়া যায়, ধান পাকা শুরু হয়েছে। এখন গ্রামে অনেকে এসেছে। ছোটদের পড়াশোনা কবে শুরু হবে লিখেছেন। গ্রামে এখন এত শিক্ষিত লোক। আপনার এক বউ ইউনিভার্সিটি পড়া। স্কুল-কলেজ বাড়িতে শুরু করে দেন। খাওয়া-দাওয়া ও পানির প্রতি খেয়াল রাখবেন। আজকাল তো আবার ডাক্তার পাওয়া মুশকিল হবে। [...] আমাদের জন্য আপনারা ভাববেন না। ভেবে কী লাভ। যখনই সম্ভব হবে আমি আপনাদের কাছে পৌঁছব। আপনারা সাহস হারাবেন না। [...]ইতি,আপনার স্নেহেরতাহের। (একাত্তরের চিঠি, পৃষ্ঠা : ১২৬)

কেউ সাহস হারায়নি। তাহেরের স্বপ্নের অংশীদার হয়ে পরিবারের সবাই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। রিকশা কিংবা গাড়ি চলাচলের উপযোগী রাস্তা না থাকায় তাঁদের গ্রামের বাড়িটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে একটি ঘাঁটির মতোই। শহর ছেড়ে আসা বহু মানুষ কাজলার বাড়িতে আশ্রয় পেত। আশরাফুন্নিসা ছিলেন তাদের অভিভাবক। ছেলেমেয়েরা সবাই ভারতে গেলেও মা-বাবা কাজলায় গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। রাতে বাড়ির উঠানে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শোনে গ্রামবাসী। একদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকাররা বাড়ি আক্রমণ করে। সে সময় সবার বড় সন্তান আরিফুর রহমান স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বাড়িতে ছিলেন। কারণ ভারতের আশ্রয়কেন্দ্র, যেখানে তাঁরা ছিলেন, সেখানে কলেরায় মানুষজন মারা যাচ্ছিল। তাই তাঁরা সাময়িক কালের জন্য কাজলার গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন।

মা-বাবা, বড় ভাই ও তাঁর পরিবারকে হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায় ময়মনসিংহ সেনাসদরে। সবাই মুক্তিযোদ্ধা ড. আনোয়ার হোসেন ধরে নিয়েছিলেন তাঁরা আর ফিরে আসবেন না। আশরাফুন্নিসা নানা ভাষায় অল্পবিস্তর কথা বলতে পারতেন। পাকিস্তানি অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার আবদুল কাদের খান, যিনি পশ্চিম পাকিস্তানে আবু তাহেরের ঊর্ধ্বতন অফিসার ছিলেন, তাকে উর্দুতে যে সাহসিকতায় অভিযুক্ত করেছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর নিরস্ত্র মানুষ ও নারীদের ওপর হত্যা ও ধর্ষণ বিষয়ে, তাতে সেই পাঠান অফিসার অভিভূত হয়েছিলেন। সসম্মানে আশরাফুন্নিসা-মহিউদ্দিন আহমেদ ও আরিফুর রহমানের স্ত্রী-পুত্রকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

আবদুল কাদের খান বলেছিলেন, ‘আপনার ছেলে মেজর তাহের আমার প্রতিপক্ষ। সে অসম সাহসী। তাঁকে খবর পাঠাবেন সে যেন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। কারণ আপনাদের দেশ স্বাধীন হবে। সেখানে তাহেরের প্রয়োজন।’

যে মা-বাবা অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে যাননি, তাঁরাই কামালপুর যুদ্ধে আহত হওয়ার পর গৌহাটি সামরিক হাসপাতালে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক তাঁদের আহত পুত্র তাহেরকে দেখতে। সেক্টর হেডকোয়ার্টারের একজন স্টাফ অফিসার হিসেবে আরেক সন্তান আনোয়ার হোসেনকে পাঠানো হয়েছিল তাহেরের সাথে। তাহেরের মৃত্যুর আশঙ্কা তখনো যায়নি। তার পরও মা চোখের পানি ফেলেননি। এক গরবিনী মায়ের চেহারাই সেদিন হাসপাতালের বিছানায় শায়িত পুত্রের মুখ পানে চেয়ে নিশ্চয়ই বলেছিলেন, ‘নান্টু (তাহের), দেশের স্বাধীনতার জন্য পা হারিয়েছ, আমাদের দুঃখ নেই, তোমার জন্য আমরা গর্বিত।’

সেই আবু তাহের, বীরউত্তমকে স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা কারাগারে প্রহসনের তথাকথিত বিচারে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন জেনারেল জিয়া, যাঁর জীবন বাঁচিয়েছিলেন কর্নেল তাহের। ফাঁসির আগের দিন শেষ দেখায় মা ছিলেন নিষ্কম্প, স্থির। কারণ তাঁদের পুত্রের চেহারায় কোনো ভয়-শঙ্কা তাঁরা দেখেননি। গৌহাটির সামরিক হাসপাতালের শয্যায় আহত পুত্রকে যেমন অভয় দিয়েছিলেন, তেমনি আরেকবার নিঃশঙ্কচিত্ত পুত্রের অমরত্ব! লাভের পূর্বক্ষণে তাঁকে শেষ আশীর্বাদ ও অভয় জানালেন মা আশরাফুন্নিসা। শুধুমাত্র ফাঁসিতে মৃত্যুর পর লাশ হেলিকপ্টার থেকে নামানোর সময় স্ট্রেচারে জেলখানার একটা মলিন চাদরে তাহেরকে দেখে হইচই করতে থাকেন, ‘আমার ছেলে কি একটা ভালো চাদরও পেতে পারে না?’

মৃত্যুর পূর্বে কর্নেল তাহেরের বড় ভাই ইউসুফকে লেখা চিঠি—যেখানে তিনি সোনার বাংলা স্বপ্নের কথা লিখেছিলেন, ‘আমি এমন একটা বাংলাদেশের কল্পনা করি যার নদীর দুপাশে উঁচু বাঁধ। সে বাঁধের ওপর দিয়ে চলে গেছে সোজা পাকা রাস্তা, চলে গেছে রেললাইন, ইলেক্ট্রিসিটি, গ্যাস, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ লাইন। বাঁধের দুই পাশে ছড়ানো গ্রাম। সেখানে নির্দিষ্ট দূরত্বে সুন্দর নকশার অনেক বাড়ি নিয়ে এক একটা জনপদ। প্রতিটা বাড়ির সামনে একটা সবুজ ঘাসে ঢাকা বাগান, সেখানে ফুল। একদিকে খেলার মাঠ। বিকেলবেলা বুড়োরা এই মাঠের চারপাশে বসে গল্প করে। ছেলেমেয়েরা মেতে ওঠে নানা খেলায়। সকালবেলা সামনের সোজা রাস্তা দিয়ে বাসের হর্ন শোনা যায়। হইচই করে ছেলেমেয়েরা যায় স্কুলে। এই দৃশ্যটা আজকে ভাবছিলাম। আমার বিশ্বাস ভাইজান, এমন একটা দেশ একদিন হবে।’ ‘নিশ্চয়ই হবে নান্টু (তাহের), আমরা লড়াই করে যাব।’ বড় ভাই ইউসুফ বলেন।

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বামীর মৃত্যুর পরও আশরাফুন্নিসা কাজলার বাড়িতে থেকেছেন। গ্রামের আত্মীয়-অনাত্মীয় নির্বিশেষে বহু নরনারী তাঁর স্নেহের পরশ পেয়েছেন। মাঝে মধ্যে ঢাকায় এসেছেন। পালা করে বেঁচে থাকা পুত্র-কন্যাদের বাড়িতে থেকেছেন। নিউ পল্টন রোডে পুত্র আনোয়ার হোসেনের বাসা থেকে প্রতিদিন খুব ভোরে তিনি ঘুরে আসতেন আজিমপুর গোরস্তান। তাঁর সবচেয়ে সুদর্শন পুত্র বাহার ও তার তিন সাথীর কবর জিয়ারত করতেন। পরিণত বয়সের সেসব সন্তানদের মধ্যে দুই খেতাবপ্রাপ্ত পুত্র তাহের ও বাহার এবং কন্যা শেলীর মৃত্যু দেখতে হয়েছে তাঁকে।

১৯৯৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সবচেয়ে কনিষ্ঠ সন্তান প্রিয় ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের বাসায় চোখ বন্ধ করেন আশরাফুন্নিসা। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে সন্ধানীতে তিনি নিজে গিয়ে তাঁর চোখ দুটো দান করে এসেছিলেন। আশরাফুন্নিসার চোখ দিয়ে এখন পৃথিবী দেখেন বিক্রমপুরের টঙ্গীবাড়ির বেতকা গ্রামের আমজাদ। পত্রিকায় কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখলেন রবিঠাকুরের বাণীতে শোকগাথা চোখ নিয়েই।‘নয়ন সমুখে তুমি নাই নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।’

পরিচয়কর্নেল তাহের, সেক্টর কমান্ডার-১১, বীরউত্তম; আবু ইউসুফ বীরপ্রতীক; মো. ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীরপ্রতীক; মো. সাখাওয়াত হোসেন বাহার, বীরপ্রতীক; আবু সাঈদ আনোয়ার হোসেন, ডালিয়া এবং জুলিয়া।

মুক্তিযোদ্ধা : সেক্টর ১১ সাক্ষাৎকারগ্রহণ : জানুয়ারি১০, ২০১১ এবং ২৪ আগস্ট ২০১১। উদয়ন টাওয়ার, ফুলার রোড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আবাসিক এলাকা, ঢাকা এবং জসীম উদদীন রোড, সেক্টর-৪, উত্তরা আবাসিক এলাকা, ঢাকা।

কৃতজ্ঞতা : মুক্তিযোদ্ধা ডা. আনোয়ার হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা ডালিয়া এবং লুৎফাতাহের।

তথ্যসূত্র

‘একাত্তর মুক্তিযোদ্ধারমা’, মার্জিয়া লিপি, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ৪৬/১ হেমেন্দ্র দাস রোড, সূত্রাপুর, ঢাকা-১১০০।

এইচআর/ফারুক/এমকেএইচ