মতামত

চেতনাদীপ্ত মার্চে হোক দেশপ্রেমের জাগরণ

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে, অগ্নিঝরা মার্চের আগে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার সুখবর পেল দেশের মানুষ। মার্চ বাঙালির জীবনে এক অনন্য চেতনাদীপ্ত মাস। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চ পাকিস্তানি জান্তার সার্চলাইট অপারেশন চালিয়ে নির্বিচারে বাঙালি নিধন, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা— সর্বোপরি মুক্তিকামী জনতা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের জন্য আনুষ্ঠানিক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে এই মার্চ থেকেই। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর বাঙালি যে তার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে এগোচ্ছিল তা স্পষ্ট হয়ে যায় এই মার্চের শুরুতেই।

Advertisement

পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ বেতার ভাষণে ৩ মার্চের গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এ সময় ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান বনাম বিশ্ব একাদশের ক্রিকেট খেলা চলছিল। ইয়াহিয়া খানের ওই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকরা খেলা ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ততক্ষণে হাজারো মানুষ পল্টন-গুলিস্তানে বিক্ষোভ শুরু করে দিয়েছে। সেই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়।

১ মার্চ মতিঝিল-দিলকুশা এলাকার পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। ক্ষুব্ধ ছাত্ররা সেখানে গিয়ে প্রথমবারের মতো স্লোগান দেয়, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। ছাত্ররা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে কর্মসূচি ঘোষণার দাবি জানায়। বিক্ষোভ-স্লোগানে উত্তাল ঢাকাসহ সারা দেশ। আর কোনো আলোচনা নয়, এবার পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার দাবি ক্রমেই বেগবান হতে থাকে।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর বজ্রনিনাদ কণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ঘোষণার পর বাঙালির মধ্যে দেখা গেল এক নতুন উজ্জীবন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেই বঙ্গবন্ধু ‘যার যা আছে’ তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বললেন। ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি’ বলে তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানালেন। এই দুর্গ গড়ে তোলার অর্থ যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা তা বুঝতে কারো বাকি রইল না। শত্রুর মোকাবিলা করার দৃপ্ত আহ্বানও ভেসে উঠল তাঁর বজ্রকণ্ঠে। সেনাবাহিনীর প্রতিও তিনি উচ্চারণ করলেন সতর্কবাণী। প্রয়োজনে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়ার কথাও বললেন তিনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যে ম্যান্ডেট তিনি পেয়েছিলেন বস্তুত সেই ম্যান্ডেটই তাঁকে প্রচণ্ডরূপে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল।

Advertisement

এরই মধ্যে নানা কূটকৌশল চালাতে থাকে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে চলতে থাকে টালবাহানা। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে চতুরতার সঙ্গে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। এভাবেই ঘনিয়ে আসে ২৫ মার্চের কালরাত। পাকিস্তানি জান্তারা ভারী অস্ত্র, কামান নিয়ে অপারেশন সার্চলাইটের নামে এ দেশের ছাত্র, শিক্ষক, জনতাসহ নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। তারা রাজারবাগ পুলিশ লাইনসেও হামলা চালায়। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে গোটা জাতি। যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে যায় এ দেশের মুক্তিপাগল মানুষ। শুরু হয় ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রাম।

এবারের মার্চ এসেছে এমন একসময়, যখন নানা ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। এ উপলক্ষে গত শনিবার ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে এ সুসংবাদ দেন। এ সময় তিনি যেসব কথা বলেন তাও প্রণিধানযোগ্য। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করেছি। সমগ্র জাতির জন্য এটা অত্যন্ত আনন্দের এবং গর্বের। আমাদের এই উত্তরণ এমন এক সময়ে ঘটলো, যখন আমরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি; আমরা মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ কৃতিত্ব এ দেশের আপামর জনসাধারণের। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এই মাইলফলক অর্জন করতে পেরেছি। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি প্রত্যয়ী ও মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে জায়গা করে নেবে। আমাদের এ অর্জনকে সুসংহত এবং টেকসই করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য এটি একটি বিশেষ ধাপ।’

পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কয়লাভিত্তিক মাতারবাড়ি বিদ্যুতকেন্দ্র কর্ণফুলী টানেলসহ অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে উন্নয়নের রোল মডেল। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা—যাতে আগামী বছর থেকে যান চলাচল শুরু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির যে কলঙ্কতিলক এঁকে দিয়েছিল, কানাডার আদালতে এ সংক্রান্ত রায়ে সেগুলোকে ‘গালগল্প’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলাদেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বে। যুদ্ধাপরাধের বিচারেও অনেক অগ্রগতি হয়েছে। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে তাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দোসরদের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে।

Advertisement

স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির কথা এত দিন নানাভাবে শোনা যেত। এই বিভক্তি এখন এতটাই স্পষ্ট যে তাদের চিনতে আর অসুবিধা হচ্ছে না। যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে রাজনীতিতে যে নতুন মেরুকরণ হয়েছে তাতে সব কিছু স্পষ্ট হয়ে গেছে। একদিকে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি, অন্যদিকে স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি। এখন বাংলাদেশের মানুষকে সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ পেতে হলে কোন পক্ষে অবস্থান নিতে হবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধ স্রোতের রাজনীতি চলতে পারে না। এখানে অবস্থান স্পষ্ট করতে না পারলে আমাদের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সার্বিকভাবে দেশের এগিয়ে চলা বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য।

সমাজে একটি আদর্শিক বিরোধ বজায় রেখে সমঝোতা আশা করা বাতুলতা মাত্র। নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক যে সংকট তারও মূলে কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির রাজনীতিতে সক্রিয়তা। একদিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রীদের ফাঁসি হচ্ছে, আবার সেই রাজনৈতিক শক্তিই ‘গণতন্ত্র গণতন্ত্র’ বলে চিৎকার করছে। এই বৈপরীত্য মেনে নেওয়া যায় না। যারা দেশের অস্তিত্বেই বিশ্বাস করে না, একাত্তরে দেশের জন্মেরই যারা বিরোধিতা করে গণহত্যা ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগে অংশ নিয়ে তাদের অবস্থান আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে তথাকথিত গণতন্ত্রের নিক্তিতে মাপার সুযোগ নেই। এখানে একটি স্পষ্ট ভেদরেখা টানতে হবে।

চেতনাদীপ্ত মার্চে নতুন করে শপথ নিতে হবে। সব অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং তা করতে হবে দেশপ্রেমের জাগরণ ঘটিয়ে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্টharun_press@yahoo.com

এইচআর/জেআইএম