মতামত

আলোচিত তিন রায় ও বন্যার বিবৃতি!

রাজন ভট্টাচার্য

Advertisement

ভাষার মাসে ১০ তারিখের পর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত মামলার রায় হয়েছে। প্রথমটি প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন অপরটি ব্লগার ও বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়, সর্বশেষ ১৭ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পেতে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা মামলার রায় এসেছে। দুটি হত্যা মামলার রায় নিম্ন আদালতের। বোমা পুঁতে রাখা মামলাটির রায় উচ্চ আদালতের।

তবে তিনটি ঘটনার মিল রয়েছে এক জায়গায়। সেটি হলো- প্রতিটি ঘটনার সঙ্গেই যুক্ত জঙ্গিরা। ঘটনার পরম্পরায় এটি অনেকটাই স্পষ্ট ২০০০ সালের আগে থেকেই দেশে জঙ্গিরা ঘাঁটি গেড়েছিল। আর নিজেদের অবস্থান শক্ত করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টায় বোমা পুঁতে রেখে শক্তির জানান দিয়েছিল। যার ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাইয়ের উত্থান থেকে শুরু করে দীপন, অভিজিৎসহ একের পর এক হত্যা এবং হামলার ঘটনা ঘটে।

জাগৃতি ও শুদ্ধস্বর- দুই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকেই লেখক অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশিত হয়েছিল। উগ্রবাদীদের পরিকল্পিত হামলার শিকার এই দুটি প্রতিষ্ঠান। উভয় ঘটনাতেই জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের নাম ওঠে আসে। এতেই তারা দমে যেতে হয়তো রাজি ছিল না। তাই বিজ্ঞান আর চেতনার কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দিতেই অভিজিৎকে নিশানা করে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এতে এও প্রমাণিত হয় জঙ্গিরা একই নেটওয়ার্কে ছক কষে কষে এগিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে।

Advertisement

গুরুত্বপূর্ণ এই মামলাগুলোর রায় যত দ্রæত হওয়ার আশা ছিল, তা হয়নি। তবে রায় দ্রুত কার্যকর করা হবে, এমন আশা করা যেতেই পারে। তা ছাড়া, জঙ্গিবাদ নির্মূলে প্রতিটি মামলার রায় দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি- এ কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। সেইসঙ্গে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে।

কথা হলো অভিজিৎ হত্যা মামলার রায়ের পর তার স্ত্রী বন্যা আহমেদ যে বিবৃতি দিয়েছেন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি স্পর্শকতারও বটে। তিনি চরমপন্থা নির্মূলে রাষ্ট্রের সৎ অভিপ্রায় না থাকার যেমন আঙুল তুলেছেন, তেমনি এই হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি মেজর অব. জিয়ার অবস্থান সম্পর্কে সরকারের কাছে খোঁজখবর না থাকার কথাও স্পষ্ট করেছেন। সেইসঙ্গে এ ধরনের মামলা পরিচালনায় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সদিচ্ছার অভাব তার কাছে স্পষ্ট হয়েছে।

তিনি অভিযোগ করেন, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসারের ক্ষেত্রে সরকার বাকস্বাধীনতা রোধ করেছে এবং এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। স্বামী হত্যা, জঙ্গিবাদের উত্থান ও দূর থেকে বিচারকাজ পর্যবেক্ষণ করেই হয়তো তিনি নিজের উপলব্ধি ব্লগে দেয়া বিবৃতিতে তুলে ধরেছেন। স্ত্রী হিসেবে স্বামী হত্যার বিচার চাওয়া স্বাভাবিক। তেমনি পুরো ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থেকে অভিজ্ঞতায় তিনি মিথ্যা বলার কথা নয়। তা ছাড়া, তিনি যেসব অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন তা সাধারণ মানুষ হিসেবে সবার চোখে কমবেশি স্পষ্ট।

সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতি অনুগত থাকা, পরোক্ষ সহযোগিতা করা, ভয় পাওয়া, প্রকাশ্যে তাদের সঙ্গে আপস করা মানেই মৌলবাদকে উসকে দেয়া। এই অভিযোগ থেকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে সরিয়ে নেয়ার সুযোগ একেবারেই নেই। আর মৌলবাদ থেকেই জঙ্গিবাদের সৃষ্টি, ধর্মীয় কট্টরপন্থীরা আরো উৎসাহিত হয়ে নিজেদের ভয়ংকর রূপে প্রকাশের সাহস দেখায়। তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে মাঠে নামে। সেই সঙ্গে উগ্রবাদীদের আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের পৃষ্ঠপোষকতা তো রয়েছেই।

Advertisement

দুই.

গত ১০ ফেব্রুয়ারি জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় অভিযুক্ত আটজন আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেয়া হয়েছে। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল এ রায় দেন। এরা সবাই জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য বলে জানানো হয়। এ ২০১৫ সালে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে ফয়সাল আরেফিন দীপন খুন হওয়ার পর হত্যার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছিল আনসার আল ইসলাম নামের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন।

এদিকে আরেফিনকে হত্যার দিনেই ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর লালমাটিয়ায় আরেক প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে এর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে একই কায়দায় কুপিয়ে আহত করা হয়েছিল। জাগৃতি ও শুদ্ধস্বর- দুই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকেই লেখক অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশিত হয়। দুটি ঘটনাতেই জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের নাম আসে।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রায় ছয় বছর আগে একুশে বইমেলা চলার সময় জঙ্গি হামলায় নিহত ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় আদালত পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। এ ছাড়া অভিযুক্ত আরো একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলায় স্ত্রীর সঙ্গে বেড়াতে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়। মেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির কাছে তার ওপর প্রকাশ্যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে অতর্কিত হামলা চালানো হয়। হাসপাতালে নেয়ার পর সেই রাতেই মারা যান অভিজিৎ রায়।

সর্বশেষ গত ১৭ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পেতে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। নিম্ন আদালত আরো চারজনের যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছিল, হাইকোর্ট তাদের একজনকে খালাস দিয়েছেন এবং বাকিদের সাজা বহাল রেখেছেন।

যাদের মৃত্যুদণ্ড এবং সাজা বহাল রয়েছে, তাদের প্রত্যেকেই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল বলে মামলায় উল্লেখ রয়েছে। ২০০০ সালের ২০ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলের পাশে বোমা পেতে রাখা হয়েছিল। পুলিশ তদন্তের পর ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয় ২০০১ সালে।

তিন .

অভিজিৎ হত্যা মামলার রায়ের পর মুক্তমনা সম্পাদক রাফিদা বন্যা মুক্তমনা ব্লগে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘...এই নির্মম হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী মেজর অব. জিয়া পলাতক। কর্তৃপক্ষের তার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।’

রাফিদা বন্যা আরো লিখেছেন, ‘...এও লক্ষণীয় যে, তদন্তকারীরা এই হত্যাকাণ্ডে ১২ জনের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়ার পরও ছয়জন চার্জশিট থেকে বাদ পড়েছিল। কারণ এই ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের সন্ধান পাওয়া যায়নি...। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করি যে, অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী বন্যা আহমেদের সাক্ষ্য নিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছিল, যিনি একই হামলায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমরা অনুভব করি যে সরকার এই মামলাগুলো বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় চরমপন্থা নির্মূলের কোনো সৎ অভিপ্রায় ছাড়াই পরিচালনা করেছে...।’

মুক্তমনা বলেছে, ‘আমরা স্পষ্ট বলছি যে বাংলাদেশ সরকার কেবলমাত্র অভিজিৎ রায় এবং অন্যান্য লেখক হত্যার মূল পরিকল্পনাকারীদের ধরতে ব্যর্থ হয়নি, বরং ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসারের ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতা রোধ করেছে এবং এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ...।’

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা বিশ্বাস করি, দীর্ঘদিন থেকে দেশটির ইসলামীকরণ ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের মূল সংবিধানের মতাদর্শগত প্রতিশ্রুতিকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করছে এবং জঙ্গিবাদীদের উত্থান ঘটিয়েছে; যার ফলে হত্যা করা হয়েছে অভিজিৎ রায়সহ জাতির অনেক সূর্যসন্তানকে।’

চার.

তিনটি রায়ের মধ্য দিয়ে দেশ থেকে জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ মুছে যাবার নয়। কারণ, মৌলবাদের নেটওয়ার্ক, অর্থনৈতিক শক্তি অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সাধারণ মানুষকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ বিনিয়োগ করে নিজেদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করছে তারা। এটাও সত্য যে অনেকেই মনের অজান্তে অন্ধকার জগতে প্রবেশ করছে। এ জন্য সবার আগে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বিনির্মাণে রাজনৈতিক অঙ্গীকার জরুরি। প্রয়োজন জাতীয় চেতনার জাগরণ। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকে ’৭২-এর মূল চেতনার সংবিধানে ফিরে আসতে হবে। তবেই রাজনৈতিক শক্তির কাছে পরাজিত হবে সব অপশক্তি।

লেখক : সাংবাদিক, অধিকারকর্মী।

এইচআর/এমএস