আলতাফ পারভেজ। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস বিষয়ক গবেষক। লিখছেন রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক অভ্যুত্থান এবং পরে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া বিক্ষোভসহ বিভিন্ন বিষয়ে মুখোমুখি হয়েছেন জাগো নিউজের।
Advertisement
এই বিশ্লেষক মনে করেন, মিয়ানমারের আন্দোলনে তারুণ্যই জিতবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের জনআন্দোলনে সমর্থন জানানো উচিত বলেও মত দেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ: আপনি বার্মা তথা মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখছেন নিয়মিত। সেনা অভ্যুত্থানের এক মাস হতে চলল? কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে যে জনবিক্ষোভ, তা আগে দেখেননি বার্মার সেনাশাসকেরা। বার্মার ভবিষ্যৎ কোন পথে?
আলতাফ পারভেজ: বার্মার ভবিষ্যৎ একইসঙ্গে অনিশ্চিত এবং আশাবাদী হওয়ার মতো। অনিশ্চিত এ কারণে যে, হঠাৎ করে এই অভ্যুত্থান হলো এবং অভ্যুত্থানকারীরা দেশকে কোনো ইতিবাচক ধারায় নির্দেশনা দিতে পারছে না। দেশটির আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মিত্ররাও বেকায়দায় পড়েছে। পর্যটনসহ নানা খাতেও সমস্যা হয়েছে। আস্তে আস্তে দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাড়ছে। এতেও দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব কিন্তু আরও বাড়বে।
Advertisement
অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের রাস্তায় সামরিক বাহিনীর সাঁজোয়া যান
আর আশার দিক হলো, অভ্যুত্থানকারীদের সম্পর্কে জনগণ কোনো মোহে নেই। মাত্র একমাস হয়নি, এর মধ্যেই সেখানে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বার্মার ইতিহাসের বড় বড় সমাবেশগুলো হয়ে গেছে এবং আরও হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় তরুণ-তরুণীরা এসব সমাবেশ করছে এবং প্রতিদিন তারা নতুন নতুন সৃজনশীল উপায়ে প্রতিবাদ করছে। যারা এতো দিন বলেছেন, বিশ্বে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমছে, তাদের ভুল ভেঙে দিচ্ছে বার্মার এই জনআন্দোলন। আরও একটা কারণে এই আন্দোলন আশাবাদী করে। তা হলো, রোহিঙ্গাদের প্রতি অতীত আচরণের জন্যও আন্দোলনকারীরা দুঃখ প্রকাশ করছে।
জাগো নিউজ: ২০০৮ সালের নির্বাচনে সরকার গঠন করে অং সান সু চি-ই সেনাবাহিনীর ক্ষমতা বাড়ালেন। তার মানে অং সান সু চির এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে, তা অনেকটাই অনিবার্য ছিল? সু চির ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে?
আলতাফ পারভেজ: নির্বাচন ২০০৮ সালে হয়নি। একটা হয়েছে গত নভেম্বরে। আর হয়েছে পাঁচ বছর আগে। এসব হচ্ছে ২০০৮ সালের সংবিধানের আলোকে। এই সংবিধান অনুযায়ী দেশটির মন্ত্রিসভায় তিনজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী থাকেন সশস্ত্র বাহিনী থেকে। পার্লামেন্টেও তাদের ২৫ ভাগ আসন থাকে। এসব সু চি করেননি। সেনাবাহিনী সংবিধান তৈরির সময় এসব ব্যবস্থা করে নিয়েছে। সু চি এই সংবিধান বদলাতে চান। কিন্তু ব্যবস্থাটা এমন যে তাতে সেনাবাহিনীর সম্মতি লাগবেই। ঠিক এখানেই বার্মার রাজনৈতিক সংকট। সু চি, সেনাবাহিনী ও জনতার আকাঙ্ক্ষা এখানে এসে মিলছে না।
Advertisement
জাগো নিউজ: মিয়ানমারের বিক্ষোভ থেকে চীনকে বয়কটের ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্ব বাড়ছে। গণতন্ত্রের জন্য বিশ্ব মহলের সহায়তা চাইছে বিক্ষোভকারীরা। কে জিততে পারে, চীন নাকি যুক্তরাষ্ট্র?
আলতাফ পারভেজ: আমি তো স্পষ্ট দেখছি, এই সংগ্রামে বার্মার তরুণ-তরুণীরা গণতন্ত্রের সংগ্রামে জিততে চলেছেন। এই সংগ্রামের প্রতিপক্ষ হিসেবে সেনাবাহিনীর অপ্রকাশ্য মদদদাতা হিসেবে চীনের প্রতি মানুষের বিরাগ বাড়ছে। গণতন্ত্র সংগ্রামীরা দেখছে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থন দিচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দেশটার দিকে তাদের আগ্রহ বাড়ছে। আমার নিজস্ব মত হলো, চীনকে এই ঘটনা বেকায়দায় ফেলেছে। তাদের হিসাবে ভুল ঘটেছে। সেনাবাহিনীও ভুল করেছে। তাদের আপস করতে হবে। এই আপসের চেহারা কী রকম হবে সেটা বলা মুশকিল। তবে এ পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনী ও চীন যদি আপস না করে, তাহলে তাদের অপর বিকল্প হলো চরম দমন-পীড়ন। সেটা হবে মহাভুল।
সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সরব মিয়ানমারের তরুণ-তরুণীরা
জাগো নিউজ: মিয়ানমারের এ ঘটনা রোহিঙ্গাদের কী ভাবাচ্ছে বলে মনে করেন? ‘রোহিঙ্গা আলোচনায়’ নতুন কী যুক্ত হতে পারে?
আলতাফ পারভেজ: এই ঘটনায় রোহিঙ্গা ইস্যু আরও পেছনে পড়ে গেল। বিশ্ব সম্প্রদায় এই অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে বলে মনে হয় না। আর এই সামরিক শক্তিও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করবে বলে মনে হয় না। কারণ এদের অভিযানেই তো রোহিঙ্গারা দেশান্তরী। সেনাবাহিনীর তৈরি সংবিধানই তো রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয় লোপাট করেছে।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ নীরব। এই ‘নীরবতা’ দেশটির সেনাবাহিনী, নাকি বিক্ষোভকারীদের পক্ষে যাচ্ছে? এর ফল কী হতে পারে?
আলতাফ পারভেজ: বাংলাদেশ খুব সোজাসাপটা এই অভ্যুত্থানের পক্ষ নেয়নি। বিরোধিতাও করেনি। বাংলাদেশ হয়তো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে । বাংলাদেশে অনেকে শুরুতে ভেবেছিলেন এই অভ্যুত্থান হয়তো রোহিঙ্গা ইস্যুতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। এরকম বিবেচনার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। রোহিঙ্গা ইস্যুর টেকসই সমাধান হতে হলে আগে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি লাগবে। সশস্ত্রবাহিনী ওটা কীভাবে মেনে নিতে পারবে? কারণ ওটা কেড়ে নিয়েছে তো ওদের তৈরি সংবিধান ও নাগরিকত্ব আইনই। আমার মনে হয়, দূর থেকে পরোক্ষভাবে হলেও, বাংলাদেশ না হোক, এখানে আশ্রিত রোহিঙ্গারা অন্তত জানাতে পারে যে তারা বার্মার গণতান্ত্রিক সংগ্রামে আছে। এটা ভবিষ্যতের জন্য একটা ভালো বিনিয়োগ হতে পারে।
এএসএস/এইচএ/এমএস