মতামত

বয়ঃসন্ধি ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা

ইরানী বিশ্বাস

Advertisement

মানসিক রোগ বা মানসিক সমস্যাকে ইংরেজিতে বলা হয় মেন্টাল ডিজঅর্ডার। এটি একটি মানসিক ও ব্যবহারিক পরিবর্তন, যা নিয়মনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি বা স্বাভাবিক জীবন থেকে আলাদা। বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, জিনতত্ত্ব এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার জটিল ক্রিয়ার ফলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ ও কর্মক্ষমতার বিপর্যয়কে মানসিক রোগ বা মানসিক সমস্যা বলে। অজ্ঞতা আর অসচেতনতা মানসিক রোগ বা মানসিক সমস্যার মূল কারণ। সাধারণত দুশ্চিন্তা, অবসাদ ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব, বংশগত কারণ, বিভিন্ন শারীরিক রোগ, শারীরিক দুর্বলতা, যৌন দুর্বলতা, মাথায় আঘাতজনিত প্রদাহ, অল্প বয়সে পুষ্টিহীনতা, ভিটামিনের অভাব, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের ত্রুটি, অতি সন্দেহ, অতি অর্থ ইনকামের দিকে মনোনিবেশের কারণে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে মানসিক রোগ হতে পারে।

জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে দুই কোটির বেশি মানুষ কোনো না কোনো কারণে মানসিক সমস্যায় ভুগছে। প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর ১৮ শতাংশের বেশি মানুষ বিষণ্নতায় আক্রান্ত, যাদের বেশির ভাগই নারী। পরিবারে সবচেয়ে কম স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিটি হলেন ওই পরিবারের নারী সদস্য। নারী নিজেকে সর্বংসহা মনে করেন। বাঙালি পরিবারে একটি মেয়ে ছোট থেকে বেড়ে ওঠে ভিন্ন দর্শন নিয়ে। ছোটবেলা থেকেই তাকে বোঝানো হয়, মেয়ে হয়ে জন্ম নিলে সংসারে তাকে সব গঞ্জনা মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। বেশিরভাগ পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী ব্যক্তি হচ্ছেন পুরুষ। তাই পুরুষের অসুখ-বিসুখে অবহেলা না করে দ্রুত ডাক্তার দেখানো হয়। যেকোনো পরিস্থিতিতে সন্তান, স্বামী, বাবা, ভাই যারই অসুখ হোক পরিবারের নারী সদস্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন তাকে সারিয়ে তুলতে। দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে পরিবারের সবার সেবা করেন।

নারীরা নিজেদের রোগ সম্পর্কে সচেতন নন। তাদের মধ্যে অসুখ লুকানোর প্রবণতা খুব বেশি থাকে। তাই জ্বর, ঠান্ডা-কাশির মতো সামান্য অসুখ কখনোই আমলে নেন না। তারা এমনকি পরিবারের অন্য সদস্যদেরও ধারণা, কয়েক দিন গেলে এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। পরিবারের নারী সদস্যদের শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়ে এমনই ধারণা হয়ে এসেছে যুগে যুগে, বিশেষ করে শ্বশুরবাড়িতে সবচেয়ে বেশি অবহেলা করা হয় নারীর স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে।

Advertisement

শারীরিক স্বাস্থ্যই যেখানে অবহেলিত, সেখানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করার সময় কোথায়? অবিবাহিত বা বিবাহিত মেয়েদের মানসিক সমস্যা হলে পরিবারের সদস্যরা বদনামের ভয়ে তাকে ডাক্তারের কাছে নিতে চান না। এছাড়া আমাদের দেশে নারী বা পুরুষ কেউই নিজেকে মানসিক রোগী হিসেবে মেনে নিতে চান না। বর্তমান সময়ে সচেতনতার কারণে অনেক পুরুষ নিজে থেকে কাউন্সিলিং করতে বা চিকিৎসার জন্য মানসিক ডাক্তারের কাছে যায়। তবে নারীদের ক্ষেত্রে এখনও তা প্রচলন হয়ে ওঠেনি।

আজ যে কন্যাশিশুটি বেড়ে উঠছে, আগামী দিনে সে-ই হয়ে উঠবে কোনো এক পরিবারের কর্ত্রী। সংসারের সবার দেখভালের দায়িত্ব তার কাঁধেই বর্তাবে। কিশোরীর বয়ঃসন্ধিতে যেমন তার মানসিক স্বাস্থ্যসেবার দরকার, তেমনি যে নারী, হয়তো মা বা কারও স্ত্রী বিশেষ বয়সে এসে মুখোমুখি হচ্ছেন মনোপজ সমস্যার, তারও ঠিক সমান ভাবে স্বাস্থ্যসেবা দরকার। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে সব নারীর মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন।

দুনিয়াজুড়ে নারীরা সবচেয়ে বেশি মানসিক সমস্যায় ভোগেন। এর পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। একটি মেয়ের বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক পরিবর্তনের মাধ্যমে জীবন প্রবাহিত হয়। প্রতিটি শারীরিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মানসিক পরিবর্তনও ঘটে। প্রকৃতিতে যেমন ছয়টি ঋতু নানা বৈচিত্র্যে হাজির হয় প্রত্যেকের আলাদা সৌন্দর্য নিয়ে। তেমনি নারীর জীবনেও প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আসে। এসব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হয় প্রাপ্ত বয়সের দিকে।

কৈশোরের প্রথম ধাপে একটি মেয়ের শরীরে বাড়তি অঙ্গ সংযোজন হওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় তার শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন। এই সময়টাকেই বলে বয়ঃসন্ধিকাল। বয়ঃসন্ধিকাল জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যেখানে এসে একটি মেয়েশিশু, কিশোরীতে পরিণত হয়। ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ও ভালোলাগার একটি সময় বয়ঃসন্ধিকাল। বয়সের এই স্টেজগুলোতে সবাইকেই একই সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। আমাদের দেশে শিশু বা কিশোরীদের শরীরের এই পরিবর্তন সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা দেওয়া হয় না। তাই আকস্মিক শারীরিক পরিবর্তন তাদের অনেক সময় মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়। অনেকেই এই পরিবর্তনকে সহজে মেনে নিতে পারে না। ফলে সমস্যাগুলো নিজের মধ্যে চেপে রেখে রেখে এক সময় তাদের মধ্যে মানসিক সমস্যা তৈরি হয়।

Advertisement

দুই.অধিকাংশ নারীর পারিবারিকভাবে দেখে-শুনে বিয়ে দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে যার সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়, তার এবং তার পরিবারের সঙ্গে মেয়েটির খুব বেশি জানাশোনার সুযোগ থাকে না। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে মেয়েটি উৎকণ্ঠায় দিন কাটায় শ্বশুরবাড়ির মানুষজন কেমন হবে, তাদের সঙ্গে এডজাস্টমেন্ট হবে কি না, স্বামীই বা কেমন হবেন, তাকে মানিয়ে নিতে পারবে কি না- এসব অনেক অজানা বিষয়ে মানসিক উদ্বিগ্নতা থেকে একসময় তার মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এরপর আছে তার গর্ভধারণের বিষয়। অনেক মেয়ে আছে, যারা গর্ভধার অক্ষম থাকেন। তাদের মধ্যে এক অজানা আতঙ্ক সার্বক্ষণিক তাড়িয়ে বেড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে স্বামীর পুনরায় বিয়ে বা শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছ থেকে অপবাদ শোনা- এ যেন চিরাচরিত প্রথা। এছাড়া রয়েছে গর্ভপাতের মতো ঘটনা। একটি নারী যখন প্রথম মা হওয়ার খবর জানতে পারে, তখন থেকে সে নিজের মধ্যে আগত সন্তানকে ঘিরে একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। হঠাৎ সেই স্বপ্নের ছন্দপতন কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। অনেকেই তাৎক্ষণিক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। আবার অনেকে ধীরে ধীরে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাছাড়া গর্ভধারণের সময় নারী বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতে পারেন। বিষণ্নতা অনেক সময় মানসিক চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় শারীরিক পরীক্ষার পাশাপাশি নারীর মানসিক যত্ন নেওয়া জরুরি।

প্রসবের পর ও মেনোপজ বা মাসিক বন্ধ হওয়ার সময় হরমনের তারতম্যের কারণে নারীর বিষণ্নতাসহ নানা রকম মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ সময় সঠিক চিকিৎসা না দেয়া হলে পরে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। নারীরা সাধারণত বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, হিস্টিরিয়া বা স্মরণশক্তি কমে যাওয়ার মতো সমস্যায় বেশি ভোগেন। প্রজননচক্রের প্রভাবে অনেক সময় মানসিক সমস্যা হয়। এছাড়া থাইরয়েডগ্রন্থির সমস্যার কারণেও অনেক সময় নারীর মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। নারীদের মধ্যে বিষণ্নতার হার পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণ। তাই আত্মহত্যার ঘটনাগুলোর ৪০ শতাংশই বিষণ্নতার কারণে ঘটে।

আগের তুলনায় কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেড়েছে। কর্মস্থলে পুরুষ আধিপত্যের কারণে অনেক সময় নারীর মানসিক চাপ থাকতে পারে। পুরুষ পরিবেষ্টিত কর্মস্থলে নারীদের লিঙ্গবৈষম্য, সমসুযোগের অভাব, যৌন হয়রানি, কাজের চাপ ইত্যাদি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এ কারণে প্রতিনিয়ত নারীদের মানসিক চাপের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা বিভিন্ন অসুখের জন্ম দেয়। মানসিক রোগীর মেজাজ বা মুড পরিবর্তনচক্রের মধ্যে আবর্তিত হতে পারে। কখনো উত্তেজনা বা উন্মত্ততায় মন বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারে। আবার কখনো অহেতুক দুঃখে মন অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। এটা কিছু সময়ের ব্যবধানে যেমন হতে পারে, তেমনি কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক মাস ধরেও চলতে পারে। এ পরিবর্তন যে মানসিক সমস্যার লক্ষণ, তা অনেক সময় অতি নিকটজনরাও বুঝে উঠতে পারে না।

করোনার করালগ্রাসে বিশ্ব এখনও প্রায় ঘরবন্দি। স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ হারিয়ে অনেকেই মানসিক বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে মানসিক রোগীর সংখ্যা। এর মধ্যে নারীদের সংখ্যা বেশি। সরকারি হিসাবে পাবনা মানসিক হাসপাতাল ও ঢাকার জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগে করোনার আগের তুলনায় এখন মাসে প্রায় আটশ থেকে এক হাজার রোগী বেশি আসছে। এর কারণ হিসেবে চাকরি হারানো, ব্যবসায় ক্ষতি কিংবা প্রিয়জনের মৃত্যুর সময় কাছে থাকতে না পারার বেদনার মতো বিষয়গুলো রয়েছে। করোনাকালে স্বজন হারানোর সময় কাছে থাকতে না পেরে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছেন।

জরিপে দেখে গেছে, করোনায় নারীর মানসিক নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। অধিকাংশক্ষেত্রে চাকরি বা কাজ হারিয়ে দিশাহীন পুরুষ ঘরের স্ত্রীকে মানসিকভাবে নির্যাতন করছে। অনেকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আবার দীর্ঘদিন বাইরে বের হতে না পেরে একই রুটিনে অভ্যস্থ হওয়া নারীরা মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। এ বিষয়গুলো আমাদের সচেতনতা কম থাকায় নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য অবহেলিত হচ্ছে ভীষণভাবে।

শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী পুরুষের তুলনায় নারী সবচেয়ে বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। একজন নারীর শারীরিক স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা অত্যাবশ্যক। অথচ এ বিষয়ে আমাদের অজ্ঞতার কারণে আমরা মনে করি মানসিক চিকিৎসার জন্য আলাদা কোনো হাসপাতাল প্রয়োজন নেই। কারণ এ হাসপাতালে প্রবেশ করা এবং বের হওয়া অনেকের জন্য লজ্জাজনক বলে অনেকেই এখানে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। এ সমস্যা সমাধানে যদি অন্যান্য রোগের চিকিৎসার মতো প্রত্যেক হাসপাতালে মানসিক চিকিৎসার জন্য আলাদা বিভাগ নিশ্চিত করা হয়, তাহলে সবাই মানসিক চিকিৎসায় উৎসাহী হবেন। সুতরাং প্রত্যেকটি সরকারি হাসপাতাল এবং কমিউনিটি হাসপাতালে অন্যসব রোগের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসেবাও নিশ্চিত হওয়া জরুরি। প্রয়োজন শুধু সচেতনতা, আন্তরিক প্রচেষ্টা, সমন্বিত উদ্যোগ এবং যথাযথ বাস্তবায়ন।

এইচআর/ফারুক/এমএস