ডা. মাহাবুবা রহমান
Advertisement
সালাম সাহেবের মেজাজ অত্যন্ত খারাপ। ঘরভর্তি মেহমান বসে আছে। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে সালাম সাহেব এতদিন পর্যন্ত নিজে কারো বাসায় যাননি, কাউকে ইনভাইটও করেননি। বাইরে থেকে ঘরে যা-ই আসে বাজার-সদায়, সব মাস্ক আর গ্লাভস পরে একটা একটা করে জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করে ভেতরে নেন। কিন্তু আজ তার স্ত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে ‘সারপ্রাইজ’ দিতে প্রায় হাফ ডজন শালা-শালি এসে বসে আছেন। তার স্ত্রী সেলিনা বেগমকেও এতে বেশ খুশি মনে হচ্ছে। সালাম সাহেব বোঝেন না, মানুষের কি বিন্দুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান নেই? উপরন্তু ঘরে ঢুকেই তার মেজো শালা ‘দুলাভাই’ বলে একদফা কোলাকুলি করে নিল। তিনি সাথে সাথেই বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার নিয়েছেন।
এখন আবার একটু আগে তার বড় মেয়ে লিনা এসে তাকে ডেকে গেলেন। সবাই না-কি এখন কেক কাটবে। ছেলে-মেয়েগুলোও হয়েছে তাদের মায়ের মত। কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই।- বাবা তুমি এখনো আসছো না?সালাম সাহেবের চিন্তায় ছেদ পড়ল। কিছু না বলে চুপ করে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। লিনা আবার বলল,- কী হয়েছে বাবা?- আমি না গেলে হয় না?- মানে? মায়ের জন্মদিনের কেক কাটব তোমাকে ছাড়া?- কেক কাটাকাটি এসব বাচ্চাদের কাজ। তোরা বাচ্চা মানুষ, তোরা থাকলেই তো হয়।লিনা এবার চোখমুখ শক্ত করে ফেলল। কঠিন গলায় বলল,- শুধু শুধু কেন মিথ্যা বলছ বাবা? আমি জানি, তুমি কেন আসতে চাচ্ছ না। আমার ধারণা, তুমি একজন অসুস্থ মানুষ। তোমার ডাক্তার দেখানো উচিত।- ডাক্তার দেখানো উচিত মানে? আমার কী হয়েছে!সালাম সাহেব অবাক।- ডাক্তার দেখানো উচিত মানে মানসিক রোগের ডাক্তার দেখানো উচিত। তুমি গত ৬ মাস ধরে কারো বাসায় যাও না, কারো সাথে মেশ না। কেউ বাসায় এলেও নিজের ঘরে বসে থাকো। ভুলেও বাইরে থেকে এসে কেউ তোমার ঘরে পা দেওয়ামাত্রই তুমি আঁতকে ওঠো! এগুলো কি তোমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়? করোনা নিয়ে টেনশন আমাদের সবারই আছে বাবা। কিন্তু তাই বলে তুমি যা করছো, সেটা কি বাড়াবাড়ি না?
সালাম সাহেব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। লিনা একটু দম নিয়ে বলল,- তোমার ওসিডি রোগ হয়েছে বাবা। আমার এক বান্ধবী আছে, ওর এই রোগ আছে। ও যা যা করে, তুমিও তা-ই করছ। তোমাকে আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাব বাবা।এমন সময় ওইঘর থেকে ডাক পড়ল। লিনা চলে গেল।
Advertisement
লিনা চলে যাওয়ার পর সালাম সাহেব অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। মেয়েটা এগুলো কী বলে গেল তাকে? সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবে মানে? তিনি তো পাগল নন! তিনি শুধু সবাইকে করোনা থেকে নিরাপদ রাখতে চান, নিজেও নিরাপদ থাকতে চান। এটা কি খারাপ কিছু? কেন সবাই এত বিরক্ত হয় তার ওপর? সালাম সাহেবের মন অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল।
সালাম সাহেবের কি আসলেও ওসিডি আছে? চলুন জানার চেষ্টা করি। তবে এ উত্তর জানতে হলে আগে আমাদের জানতে হবে ওসিডি কী।
ওসিডি: ইংরেজি ওসিডি শব্দের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ হচ্ছে- Obsessive Compulsive Disorder. অর্থাৎ এখানে দুটি অংশ আছে- ১. অবসেশন ২. কমপালশন।
অবসেশন: অবসেশন শব্দটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খুব ব্যবহার করি। যেমন প্রেমিকার প্রতি অবসেশন, কাজের প্রতি অবসেশন, সৌন্দর্যের প্রতি অবসেশন। অর্থাৎ কোনো একটি বিষয় নিয়ে একেবারে মগ্ন হয়ে থাকা। অন্যদিকে ওসিডিতে অবসেশন বলতে বোঝানো হয়েছে, ‘recurrent and persistent thoughts, urges or images’. যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, ‘বাধ্যতামূলক চিন্তা, ছবি বা তাড়না’। অর্থাৎ ওসিডি রোগীর মাথায় কোনো একটি চিন্তা বারবার আসতে থাকে, যেটি কি-না একেবারেই অযাচিত বা অমূলক চিন্তা। রোগী নিজেই সেটা বুঝতে পারেন এবং বুঝতে পারেন বলেই তিনি চান এই অযাচিত চিন্তা আসা বন্ধ করতে। এর জন্য বহু চেষ্টাও করেন। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। ফলে রোগীর প্রচণ্ড মানসিক কষ্ট হয়।
Advertisement
কমপালশন: অবসেশন থেকে সৃষ্ট মানসিক কষ্ট থেকে বাঁচতে রোগী তখন অন্য একটি কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। যেই কাজকে আমরা বলি ‘compulsion’ বা ‘বাধ্যতামূলক আচরণ’। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমপালশনের পরিবর্তে করে থাকেন avoidant behaviour।
একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি সহজভাবে বোঝা যাবে। যেমন ধরা যাক, একজন রোগীর ময়লা নিয়ে অবসেশন আছে। সারাক্ষণই তার মাথায় চিন্তা আসতে থাকে, এই বুঝি হাতটা ময়লা হয়ে গেল কিংবা শরীরে ময়লা লেগে গেল। এটা হচ্ছে তার অবসেশন। এ অবসেশনকে আমরা বলি ‘obsessional thought about dirt and contamination’। যদিও রোগী কিন্তু বুঝতে পারেন তার চিন্তাটা একবারেই অমূলক। তার হাতে বা শরীরে কোনোই ময়লা নেই। তারপরও চিন্তাটা মাথা থেকে দূর করতে পারেন না। ফলাফল, চিন্তা থেকে বাঁচার জন্য তিনি হাত ধোন। তিনি মনে করেন, একবার হাত ধুয়ে ফেললেই তো আর চিন্তা থাকল না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিনি যতই হাত ধোন না কেন, ময়লার চিন্তা তার বারবারই আসে এবং বারবারই তিনি হাত ধুতে থাকেন। এখানে এই হাত ধোয়াটা হল তার কমপালশন।
আমি উদাহরণ হিসেবে এখানে অবসেশনাল থটকে ব্যবহার করেছি। এর বাইরেও অবসেশন হিসেবে আসতে পারে কোনো ছবি অথবা তাড়না, শুরুতেই সেটা বলেছি।
ছবির ক্ষেত্রে রোগীর চোখের সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ছবি ভেসে ওঠে। যেমন খুব ভয়ঙ্কর বা অশালীন কোন ছবি (অবসেশন) এবং এই ছবি তাড়ানোর জন্য সে তখন বেশি বেশি দোয়া পড়তে থাকেন (কমপালশন)। তেমনি তাড়না বা ইমপালসের ক্ষেত্রে হুট করে কিছু একটা করে ফেলতে ইচ্ছা করে। যেমন দা-বটি দেখলেই মনে হয়, এটা নিয়ে এখনই নিজের গায়ে বসিয়ে দেই। ছাদে গেলেই মনে হয় এখনই ছাদ থেকে একটা লাফ দেই। এই urge থেকে বাঁচার জন্য রোগী হয়তো একসময় রান্নাঘর বা ছাদে যাওয়াই বন্ধ করে দেন (অ্যাভোয়েড্যান্ট বিহেভিয়ার)।
কাদের হয়: ওসিডি রোগটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অল্প বয়সেই শুরু হয়, সাধারণত বিশ বছরের আগেই। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের হওয়ার হার সামান্য বেশি। বাচ্চাদেরও ওসিডি হতে পারে।
কেন হয়: ওসিডি হওয়ার কারণ হিসাবে খুব নির্দিষ্ট কোনো কিছুকে দায়ী করা যায় না। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কে ওসিডি সার্কিট বলে একটি সার্কিট আছে, সেই সার্কিটে গোলমাল হলে কিংবা বংশের অন্য কারো এই রোগ হওয়ার ইতিহাস থেকে থাকলে রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যায়।
লক্ষণসমূহ: ওসিডি একটি চিন্তাবাতিক রোগ। যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন মানুষের চিন্তা ভিন্নরকম, সেহেতু ওসিডির লক্ষণও মানুষের চিন্তার বৈচিত্র্যে বৈচিত্র্যময়। যেমন বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বাবা-মা বা কাছের কারো ক্ষতি হওয়ার চিন্তা, বয়ঃসন্ধিকালে সেক্সুয়াল অবসেশন আবার বড়দের ক্ষেত্রে ময়লা নিয়ে, ধর্ম নিয়ে বা বারবার চেক করার অবসেশন বেশি দেখা যায়।
আবার জাতি, ধর্ম, পরিবেশ ভেদেও ওসিডির ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই ধর্মভীরু। তাই অবসেশনাল থটের কম্পোনেন্ট হিসেবে ‘religious obsession’ পশ্চিমাদের চেয়ে আমাদের দেশে অনেক বেশি দেখা যায়। যেমন ওজু করতে গেলে বারবার করতে থাকা, কিংবা ওজু বাদেও অন্য যেকোন কিছুই ধুতে গেলে নিদেনপক্ষে তিনবার ধোয়া (যেহেতু ওযু করার সময় আমরা প্রত্যেকটা স্টেপ তিনবার করি। তাই পেশেন্টের মাথায় অযাচিতভাবে চিন্তা আসতে থাকে তিনবার না ধুলে কোনকিছু পরিষ্কার হয় না), নামাজে দাড়ালেই ধর্ম নিয়ে চিন্তা আসা ইত্যাদি।
অবসেশনাল থটের কিছু উদাহরণ-
১. প্যাথলজিক্যাল ডাউটস: কোনো একটি কাজ করার পর বারবার মাথায় আসা যে, কাজটি বোধহয় ঠিকভাবে সম্পন্ন হয়নি। ফলে সেটি বারবার চেক করা। যেমন তালা লাগিয়ে বারবার তালা চেক করতে যাওয়া, চুলা বন্ধ করার পরও বন্ধ হয়েছে কি-না সেজন্য বারবার চেক করা।
২. সোম্যাটিক অবসেশন্স: অসুখ-বিসুখ নিয়ে অযাচিত চিন্তা আসা কিংবা নিজের শরীরের কোনো অঙ্গকে ত্রুটিযুক্ত মনে হওয়া।
৩. অ্যাগ্রেসিভ অবসেশন্স: ধারালো কোনো বস্তু- ছুরি বা কাচি দেখলেই নিজে বা অন্যকে আঘাত করতে ইচ্ছা হওয়া। ঘরভর্তি মানুষের সামনে হঠাৎ অশালীন কোনো শব্দ বলে ফেলা।
৪. সেক্সুয়াল অবসেশন্স: বিকৃত যৌন চিন্তা কিংবা যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না (বাবা, মা, ভাই, বোন) এমন কারো প্রতি বারবার যৌন চিন্তা আসা, বাচ্চাদের প্রতি যৌন চিন্তা আসা।
৫. হোর্ডিং: নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় জিনিস জমিয়ে রাখার প্রবণতা।
৬. নিড ফর সিমেট্রি: যেকোনো কিছু (বইখাতা, আসবাবপত্র) সব সময় একই ছকে গুছিয়ে রাখার প্রবণতা এবং এর সামান্য হেরফের হলেই প্রচণ্ড অস্বস্তি হতে থাকা।
অবসেশনের এরকম হাজারো উদাহরণ দেওয়া যায়। যেহেতু মানুষের চিন্তার কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডি নেই। সেক্ষেত্রে শুধু একটি কথা মনে রাখলেই চলবে, ‘নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অযাচিত কোনো চিন্তা বারবার মাথায় আসা এবং সেটি ওই ব্যক্তির জন্য মানসিকভাবে খুব পীড়াদায়ক হওয়া’- এটিই অবসেশন।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ওসিডি শনাক্ত করা বেশ কঠিন। কারণ বাচ্চারা তাদের অবসেশনের ব্যাপারটা কাউকে বোঝাতে পারে না, নিজেরাও বুঝে উঠতে পারে না। এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতাকে তারা অনেকসময় এভাবে ব্যাখ্যা করে, ‘ও আমাকে বলেছে এটা করতে, এটা বলতে’। অর্থাৎ চিন্তাটি যে তার নিজেরই চিন্তা এটাই বাচ্চারা বুঝতে পারে না। এবং এই ‘ও’ কে অনেক সময়ই বাবা-মায়েরা ধরে নেন কোনো জ্বীন-ভূতের আছর। এবং সেই দিকে চিকিৎসা করান। ফলে বাচ্চা ভালো না হয়ে দিনদিন আরও খারাপ হতে থাকে।
সালাম সাহেবের রোগ: ওসিডি নিয়ে তো অনেক গল্প হলো। এবারে ফিরে যাই সালাম সাহেবের গল্পে। সালাম সাহেবের কী হয়েছিল আসলে? তিনি কি সত্যিই ওসিডি আক্রান্ত?
এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এ মুহূর্তে বেশ কঠিন। সালাম সাহেবের ওসিডি থাকতেও পারে, না-ও পারে। আবার হতে পারে ওসিডি নয়, ওসিপিডি (Obsessive Compulsive Personality Disorder) আছে। আবার এও হতে পারে, তার স্বভাবটা কোনো রোগের মধ্যে পড়েই না। তিনি স্রেফ একজন খুঁতখুতে স্বভাবের মানুষ।
সম্প্রতি অল্প কিছু গবেষণায় পাওয়া গেছে যে, কোভিড-১৯ অনেকের ওসিডি রিস্ক বাড়ায়। এদের মধ্যে যাদের আগে থেকেই ওসিডি আছে; তাদের ক্ষেত্রে অসুখটির তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেছে।
তবে সঠিক ডায়াগনোসিসটা জানার জন্য সালাম সাহেবকে যেতে হবে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। কারণ বুকে ব্যথার কারণ যেমন বুকে স্টেথো না ধরে, ইসিজি না করে বোঝা যায় না, মানসিক সমস্যার কারণও ঘরে বসে কিংবা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানা যায় না। এজন্য বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতেই হবে।
মনে রাখবেন, আপনাকে চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে না, আপনার চিন্তারা যেন আপনাকে নিয়ন্ত্রণ না করে; সেটা নিশ্চিত করতে পারলেই চলবে।
লেখক: রেসিডেন্ট চিকিৎসক, চাইল্ড অ্যান্ড এডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
ওয়েবসাইট: www.drmahabuba.com
এসইউ/এমকেএইচ