সাহিত্য

অনাহূত ব্যক্তিগত: সোনালি সুতোয় বোনা কিশোরবেলা

দীপংকর দীপক

Advertisement

নাটোরের বনলতা সেন বাস্তব জীবনে হাজার বছরের ক্লান্ত পথিক কবি জীবনানন্দ দাশকে আদৌ দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল কী-না, তা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। তবে দিনাজপুরের জুঁইদি কিন্তু লক্ষ-কোটি বছরের ক্লান্ত পথিক কবি রাহেল রাজিবকে সত্যি সত্যিই দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিলেন। দীর্ঘ কিশোর জীবনের পথপরিক্রমা শেষে তিনি যৌবনে উত্তীর্ণ। দেহকাঠামো ও বেশ-ভূষায় ব্যাপক পরিবর্তন। রাজধানী ঢাকায় জীবনসংগ্রামে ব্যতিব্যস্ত ও পড়াশোনায় মগ্ন। জুঁইদি থেকে শতশত মাইল দূরে। লক্ষ-কোটি মানুষের ভিড়ে অনেকটাই বিলীন। এ অবস্থায় জুঁইদির মুখোমুখি হবেন—তা কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু সেই কল্পনাই বাস্তব হয়ে ধরা দেয় কবির জীবনে। একদিন রাজপথ দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ জুঁইদির ঝলকানি, বিদ্যুতের যেমন বিচ্ছুরণ ঠিক তেমনি। মুখোমুখি কবি ও তাঁর স্বপ্নকন্যা। তবে এখানে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব কতটা কাজ করেছে—তা গবেষণার বিষয়। কারণ পুরোটা সময় কবি ছিলেন অবচেতন। বাস্তবতায় তা কয়েক মিনিট হলেও কাব্যিকতায় তা লক্ষ-কোটি বছর ছাড়িয়ে গেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। অবেশেষে হৃদয়ে কম্পন তুলে জুঁইদি ফের হারিয়ে যান কোটি মানুষের ভিড়ে।

এভাবে বনলতা সেন ও জুঁইদিরা আসেন কবিদের জীবনে, আবার হারিয়ে যান মুহূর্তেই। কবি হয়ে পড়েন চির নিঃসঙ্গ। এই নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করেই পথ চলতে হয় তাদের। কবি রাহেল রাজিবও পথ চলছেন একাকী। এই কংক্রিটের শহরে জুঁইদি, মুভি, লিজা কিংবা কিশোরজীবনের বন্ধুদের সান্নিধ্যে থাকার জো নেই। কিন্তু কবিকে রোধ করা—সাধ্য কার? দিনের সময়টা অধ্যাপনা-গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও গভীর রাতে অবচেতন মনে ঢুঁ মারেন স্বপ্নরাজ্যে। আর সেই স্বপ্নরাজ্য থেকে হারিয়ে যান সোনার সুতোয় বোনা কিশোরবেলায়। জুঁইদি, মুভি, লিজাসহ—স্বপ্নকন্যারা ফিরে ফিরে আসেন কবির জীবনে। এভাবেই কবির কলম থেকে বোরোয় একেকটি প্রেম-বিরহের কালোত্তীর্ণ পঙক্তি।

অধ্যাপক, গবেষক ও কবি রাহেল রাজিব তার কিশোরবেলার স্মৃতির আলপনা নিয়ে সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম ‘অনাহূত ব্যক্তিগত’। এ বইয়েই বারবার উঠে এসেছে স্বপ্নকন্যা জুঁইদির কথা। কবি দিনাজপুরের ফুলবাড়ী জি এম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। এখানেই কেটেছে তার স্কুল-জীবনের বর্ণাঢ্য সময়। তার প্রিয় জি এম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় শতবর্ষে পা রেখেছে। এ উপলক্ষে স্কুল-জীবনের স্মৃতিকথা সবাইকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিতেই তার এ প্রয়াস। তবে লেখকের আকর্ষণীয় বর্ণনা, চমৎকার ভাষাশৈলী ও কাহিনির গতিময়তা—বইটিকে শুধু স্মৃতিকথায় সীমাবদ্ধ না রেখে কৈশোরের আত্মজীবনীর মর্যাদা এনে দিয়েছে।

Advertisement

বইটি পাঠ করলে যে কেউ তার কৈশোরজীবনে ফিরে যাবেন। এ বইয়ের বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে পাঠক নিজেকে খুঁজে পাবেন। এখানেই লেখকের বিশেষ সার্থকতা। এ বইয়ের মধ্যে তেমন কোনো করুণ ঘটনা নেই। তাই বইটি পড়ে চোখে জল আসার কথাও নয়। কিন্তু একজন পাঠক হিসেবে আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। একাধিক ঘটনা পড়ে আমি কেঁদেছি, গাল বেয়ে ঝরে পড়েছে অশ্রুধারা। বারবার ফিরে গেছি অতীত জীবনে। কারণ সেইসব ঘটনার সঙ্গে আমার জীবনেরও প্রায় শতভাগ মিল রয়েছে।

রাহেল রাজিব একটি সাধারণ পরিবারের ছেলে। তার বাবা একজন কাঠমিস্ত্রি। সামান্য আয় দিয়ে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতেন। তার সন্তান হবে উচ্চশিক্ষিত—এ কথা ভাবাই যায় না। বিশেষ করে ফুলবাড়ীবাসীর অনেকেই তা কল্পনা করতে পারেননি। কিন্তু কল্পনাকে বাস্তবরূপ দিয়েছেন রাহেল রাজিব। এসএসসি, এইচএসসি পাস করার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। পরে সফলতার সঙ্গে পিএইচডিও করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। একজন কাঠমিস্ত্রির ছেলের জন্য এ পথ পাড়ি দেওয়া মোটেও মসৃণ ছিল না। লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে তাকে অনেক হোঁচট খেতে হয়েছে; বঞ্চনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। স্কুলজীবনে সফলতার সঙ্গে বৃত্তি পেয়েও শুনতে হয়েছে কটুকথা। দিনশেষে বাবার মতো তাকেও ‘কাঠঠোকরা’র কাজই করতে হবে—এমনটাও বলেছেন কেউ কেউ। কিন্তু এসব শুনে তিনি মোটেও দমে যাননি। বরং লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে সমালোচকদের যুঁতসই জবাব দেওয়ার জন্য নিজেকে আরও শাণিত করেছেন।

রাহেল রাজিব একজন সাহিত্যিক হবেন—তা কৈশোরেই জানান দিয়েছিলেন। স্কুলজীবন থেকেই বিভিন্ন পত্রিকায় তার লেখা কিংবা কবিতা ছাপা হচ্ছিল। ১৯৯৮ সালে কয়েকজন বন্ধু নিয়ে তৈরি করেন সাহিত্য সংগঠন ‘কবি মানস’। এই সংগঠন থেকে তারা বিভিন্ন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনসহ মাসিক ভাঁজপত্র ও লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছেন। রাহেল রাজিবের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বর্তমানে ‘কবি মানস’ একটি জাতীয় পর্যায়ের প্রকাশনায় রূপ লাভ করেছে।

রাহেল রাজিব কবি হিসেবেও সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। এ পর্যন্ত তার ছয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে ‘জুঁইদি ও মাতাল প্রেমিক’। ইতোমধ্যেই বইটির তৃতীয় সংস্করণ মুদ্রিত হয়েছে, যা বর্তমান সময়ে ভাবাই যায় না। শুধু তা-ই নয়, সাহিত্যমহলে জুঁইদি এতটাই সাড়া ফেলেছে যে, বাংলাদেশ-ভারতের ৫৬ জন লেখক বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন। এদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মৃণালবসু চৌধুরী, বেলাল চৌধুরীসহ কয়েকজন সাহিত্যিকও রয়েছেন। এ ছাড়া দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক ভোরের কাগজের সাহিত্য সাময়িকীতে ‘জুঁইদি বিশেষ সংখ্যা’ প্রকাশিত হয়েছে। জুঁইদিকে নিয়ে সৌম্য সরকার, সাফফাত হোমায়রা, অভী চৌধুরী পূর্ণাঙ্গ কবিতার বই প্রকাশ করেছেন। তাছাড়া লেখক শিমুল মাহমুদ জুঁইদিকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখে ফেলেছেন। একজন লেখকের জীবনে এর চেয়ে বেশি প্রাপ্তির আর কী হতে পারে?

Advertisement

‘অনাহূত ব্যক্তিগত’ বইটি কবি রাহেল রাজিব তার পিতৃবৎ স্কুলশিক্ষক আব্দুল আজিজ বাবু স্যারকে উৎসর্গ করেছেন। মূলত এই বাবু স্যারের স্নেহ-ভালোবাসা, সহযোগিতা-সমর্থনেই রাহেল রাজিব এ পর্যন্ত আসতে পেরেছেন। সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বিরহে, সফলতা-ব্যর্থতায় সব সময় পাশে ছিলেন তিনি। রাহেল রাজিবের মধ্যে সাহিত্যবৃক্ষের বীজ বপন করেছিলেন তিনিই। তাই তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পাশাপাশি কবির কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

‘অনাহূত ব্যক্তিগত’ বইটি লেখকের সৃষ্ট ‘কবি মানস’ প্রকাশনা থেকেই প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রচ্ছদ এঁকেছেন রায়হান শশী। বইটির মুদ্রিত মূল্য ২০০ টাকা। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত বইটি বেঙ্গল বই (ঢাকা), বাতিঘর (ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রাম), অভিযান পাবলিশার্স (কলকাতা) ও নৈঋতা ক্যাফের (ঢাকা) পাশাপাশি অনলাইন বুকশপ রকমারি ডটকম থেকেও সংগ্রহ করা যাবে।

রাহেল রাজিব একজন নিভৃতচারী ও নিসর্গচারী লেখক। একইসঙ্গে তিনি উদারপন্থী ও শেকড় সন্ধানীও বটে। অধ্যাপনা তার পেশা। আর মনের পিপাসা নিবারণে কাব্যচর্চা করছেন। মাতৃভাষাকে বিশ্বজনীন করে তুলতে নিয়মিত লিখছেন প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। একসময় সাংবাদিকতা করতেন। সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা তার লেখার গতিকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভ্রমণের অদম্য নেশা তাকে প্রায়ই টেনে নিয়ে যায় সাধ্যের বাইরে। ভারত-নেপালসহ বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি অত্যন্ত স্বাধীনচেতা, আধুনিকমনা ও সংস্কারবিরোধী। জীবনযুদ্ধে চরম ধৈর্যশীল মানুষটি ভীষণ বন্ধুসুলভ ও পরোপকারীও বটে। তার সাহিত্যজীবনের সার্থকতা কামনা করছি।

লেখক: সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও গবেষক।

এসইউ/জিকেএস