ফিচার

করোনাযুদ্ধে যেভাবে লড়েছে ‘হীরাঝিল একতা সংঘ’

২০২০ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশে আঘাত হানে করোনাভাইরাস। তখন থেকে মূলত সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া কিছুই করার ছিল না আমাদের। সে সময় থেকে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে ‘হীরাঝিল একতা সংঘ’। ভয়ঙ্কর সেই লড়াইয়ের গল্প বলছেন অন্যতম সহযোদ্ধা এস কে শাওন-

Advertisement

গল্পের শুরু: ২০২০ সালের ১৬ মার্চ থেকে ক্যাম্পাস বন্ধ। পড়ি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে। সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের সপ্তম সেমিস্টারে। এরপর থেকে টানা কয়েকদিন বাড়িতে। কারণ সরকারের নির্দেশ, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যাবেন না। গেলেও মুখে মাস্ক পরতে হবে। গণপরিবহন এড়িয়ে চলবেন। ফিরে এসে বারবার সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলবেন। তাই ভেবেছি, করোনার সংক্রমণ থাকলে খুব প্রয়োজন ছাড়া বেরোব না। তবে বদলে দিলো ফেসবুক। অনেকগুলো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভাইরাস প্রতিরোধে লড়ছে। আমারও মন চাইল, মানুষের পাশে দাঁড়াব। পরে সংগঠনের সবার সম্মতিতে করোনাযুদ্ধে যাত্রা শুরু করলাম।

আমাদের যাত্রা: সদস্যরা প্রতি মাসের শেষ শুক্রবার ‘হীরাঝিল আইডিয়াল স্কুল’র অফিস কক্ষে নিয়মিত সভা করি। সবার মতামত নিয়ে পরের কর্মসূচি হাতে নিয়ে সফল করি। কিন্তু জনসমাগমে ভাইরাস ছড়াবে বলে সভা করিনি। কাজ করতে ভিন্ন পথ বাছতে হলো। মোবাইলে সবার সঙ্গে আলাপ করতে পরামর্শ দিলেন মনোয়ার ভাই। এরপর রাজু, সৈকত আর সোহানকে ফোন দিলাম। তারা করোনা প্রতিরোধে কাজ করতে এককথায় রাজি। ২২ সদস্যের বাকি ১৭ জনকে ভাগে ভাগে ফোন করলেন তারা। তারাও আগ্রহী। সবার সম্মতি নিয়ে কাজে নামলো ‘হীরাঝিল একতা সংঘ’।

জীবাণুর বিপক্ষে: ২৮ মার্চ বোতলে জীবাণুনাশক নিয়ে বের হলাম সবাই। ভাগে, ভাগে তিনটি স্প্রে নিয়ে কাজ শুরু করলাম। দুপুরেই একটি নষ্ট হয়ে গেল। বাকি দুটি দিয়ে কাজ করলাম। এলাকার সব মসজিদ, প্রতিটি বাসার গেট, প্রত্যেকটি দোকানের সাটারে স্প্রে করলাম। অনেকে তাদের বাড়িতে স্প্রে করার অনুরোধ করলেন। কোনো কোনো অনুরোধ ফেলতে না পেরে স্প্রে করতে হলো। এভাবে সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত টানা করোনা প্রতিরোধে কাজ করলাম। এরপর থেকে আজও সেই কাজের বাহবা পাচ্ছি। অন্যসব কাজের মতো ফেসবুকে পোস্ট দিলাম স্প্রে ছড়িয়ে পুরো এলাকার মানুষকে জীবাণুমুক্ত করার উদ্যোগও। অনেকে শেয়ার দিলেন। তবে থেমে গেলাম না। আরও কাজে নামলাম সবাই। এবার উদ্যোগ নিলাম এলাকার সব গলি জীবাণুমুক্ত করব। তবে করোনাভাইরাসের করুণ প্রভাবে সে কাজ খুব কঠিন হয়ে গেল। পাশের সব মার্কেট তো বন্ধ। ফলে উপকরণ কিনবো কোথা থেকে? তারপরও ফেসবুকে আলাপ হলো। অনেক কষ্টে জোগাড় হলো জীবাণুনাশক। অর্থাৎ এ উদ্দেশ্যও সফল করলাম।

Advertisement

লিফলেট থেকে হ্যান্ড মাইক: নিজেরা লিফলেট তৈরি করেছি, কীভাবে ভাইরাসের মোকবেলা করতে হবে? তারপর এলাকা ঘুরে ঘুরে কয়েকশ লিফলেট বিলি করেছি। সে পয়সা আমাদেরই দেওয়া। খেটে লিফলেট বানিয়েছি। করোনা মোকাবেলায় সরকারি নির্দেশও মানছেন না অনেকে। ঢাকা জেলা প্রশাসনের অফিস থেকে নির্দেশ আছে, বেলা পাঁচটার পর আর কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা যাবে না। তাতে একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে ভাইরাস ছড়াবে। কিন্তু লোভের ফলে কারো কারো চাহিদায় কোনো দোকানই প্রায় তেমন বন্ধ হয়নি। ফলে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে আলাপ করে আবাসিক এলাকার সব দোকান মালিকদের জানালাম, সরকারি নির্দেশ মানতে হবে, তাহলে তাদেরই ভালো। বেচাকেনা এ সময়ের মধ্যেই হবে। বেলা পাঁচটায় হ্যান্ড মাইকে বলেছি রাস্তায় ঘুরে। পথচারী ও আড্ডা দেওয়া ছেলেদের বাড়ি চলে যেতে অনুরোধ করেছি। টানা দুই ঘণ্টা নিরলস কাজ করেছি। সারাদেশ তখন লকডাউন। রমজানে পুরো এলাকায় হকার আরও বেড়ে গিয়েছিল। তারা সরকারের লকডাউন মানতেই চাচ্ছিলেন না। সেজন্য প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে ১২টা ও বিকাল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত এলাকা থেকে হকার সরানোর কাজ করেছি। তাছাড়া এলাকায় কিছু অসচেতন মানুষ অযথা বাহিরে ঘুরাফেরা করেন। হ্যান্ড মাইক দিয়ে তাদেরও সচেতন করার লড়াই করেছি। ছয়জনকে একটি দলে একটি হ্যান্ড মাইক নিয়ে পাড়া ভাগ করে কাজে নেমেছিলাম। তিনটি দল আমাদের। ফলে তখন শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ লোকই আর বাসার বাইরে থাকেননি। ফার্মেসি ছাড়া আর কোনো দোকানও চালু থাকেনি।

মানুষের পাশে খাবার হাতে: হীরাঝিল একতা সংঘে যাদের প্রয়োজন; এমনদের ত্রাণ বিলানোর জন্য প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে পরিবারগুলোর তালিকা করেছি। তখন ফেসবুকে আমাদের কাজ দেখে এগিয়ে এসেছেন সাইফুল ইসলাম। ভাই হীরাঝিলের পাশের মিজমিজিতে থাকেন। মোবাইলের দোকান আছে। আমরা খাদ্যসামগ্রী বিলি করব জেনে সাইফুল ভাই ৬০টি পরিবারের খাদ্যসামগ্রী নিজের খরচে আমাদের হাতে পৌঁছে দিলেন। মহৎ এ কাজের কথা জানার পর তার কয়েকজন বন্ধু খাবার কেনার জন্য যোগাযোগ করে টাকা দিয়েছেন। করোনার এ সময়ে সংগঠনের নতুন সদস্য হয়েছেন মোহাম্মদ মোরসালিন। তিনি ২০টি পরিবারের খাদ্যসামগ্রী নিজের খরচে কিনে দিয়েছেন। ২১ এপ্রিল থেকে ২৭ এপ্রিল রাতের বেলা, কেউ যাতে জানতে না পারেন ও কোনো পরিবারের অসম্মান না হয়; সেভাবে খাবার বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়েছি। সবার এ দানে হীরাঝিল, মিজমিজি ও পাইনাদী এলাকায় ১২০টি পরিবারকে খাদ্যসামগ্রী উপহার দিয়েছি। সংগঠনের কার্যক্রমের সব খবর ফেসবুকে শেয়ার দিয়েছি। তবে সুবিধাবঞ্চিত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর সামাজিক ও পারিবারিক সম্মানের কথা ভেবে খাবারের কাজগুলো ফেসবুকে শেয়ার করিনি। প্রতিটি পরিবারকে তিন কেজি চাল, দুই কেজি আলু, দুই কেজি পেঁয়াজ, এক কেজি ডাল, এক লিটার সয়াবিন তেল, এক কেজি লবণের প্যাকেট ও দুটি করে লাক্স সাবান দিয়েছি। আমাদের সাহায্যে অনেক শিশু, নারী, বয়স্ক, অসুস্থ মানুষের খাবারের সুযোগ হয়েছিল।

আমরা যারা: আমরা এলাকারই সন্তান। এখানেই বাবা-মা, পরিজন নিয়ে থাকি। নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলায় আমাদের হীরাঝিল আবাসিক এলাকা। আবাসিক এলাকা মানে মানুষের বসবাস ছাড়া আর কোনো কিছু থাকবে না। তবে সেটি হয়নি। অনেক দোকান গড়ে উঠেছে। মোট ২৫ হাজার মানুষের বসতি। তাদের ভালোর জন্য, সমাজকল্যাণের জন্য এ সংগঠনের জন্ম ও শুরু থেকে অলাভজনকভাবে কাজ করে। সব শ্রমই সদস্যদের দেওয়া। ২০১৯ সাল থেকে আমরা খুব সক্রিয়। কারো কোনো পদ নেই, সিনিয়ররাও নেননি। পদের লোভ, ক্ষমতা ও প্রতিহিংসা বাড়তে পারে বলে। সবার মতামতে সংগঠন চলে, সব কাজ হয়। মাসে ২শ টাকার চাঁদায় আজকের পৃথিবী আমরা বাসযোগ্য করি নানা সেবামূলক কাজে।

আমাদের লক্ষ্য: আমরা পাঠাগার গড়বো। সবাইকে পড়তে উৎসাহী করবো। এরপর নারায়ণগঞ্জের ভালো কোনো জায়গায় পথশিশু বিদ্যালয় করবো। তারপর সারাদেশে মানবতার ডাকে কাজ করবো। কেউ চাইলে তাদের সাহায্য করবো। আমাদের পাবেন ফেসবুকে ‘হীরাঝিল একতা সংঘ’ পেজে।

Advertisement

এসইউ/জিকেএস