ধর্ম

চির বসন্তের স্থান হবে জান্নাত

ছয় ঋতুর দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। বাংলা ছয় ঋতুর মধ্যে সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য ঋতু হলো বসন্ত। তাইতো বসন্তকে বলা হয় ঋতুরাজ। বসন্তে ফুলের রং, বাহার যেমন ভিন্ন হয় তেমনি বসন্তদূত কোকিলের কুহুতানও যেন ভিন্ন এক প্রকৃতিকে উপহার দেয়।

Advertisement

বসন্ত এলে প্রকৃতিতে লাগে রং বদলের ছোয়া আর পাতা ঝরার দিন শেষ হয়ে যায়। ধূসর প্রকৃতির ঠোঁটে ফোটে হাসি। প্রকৃতি যেন ফিরে পায় নতুন জীবন। আসলে বসন্তের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক নিবিড়। যেভাবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

‘তুমি পৃথিবীকে নিষ্প্রাণ দেখতে পাও। এরপর আমরা যখন এর ওপর পানি বর্ষণ করি তখন তা সক্রিয় হয়ে ওঠে ও ফেঁপে ফুলে ওঠে এবং প্রত্যেক প্রকার উদ্ভিদের সবুজ শ্যামল শোভামন্ডিত জোড়া উৎপন্ন করে।’ (সুরা হাজ : আয়াত ৫)

দুনিয়াতে যেমন ঋতুর পরিবর্তন হয়, জান্নাতে তেমনটি হবে না। বরং জান্নাতের আবহ ও পরিবেশ থাকবে চির বসন্ত। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার জান্নাতের বসন্ত নির্দিষ্ট কোনো মাস নয় বরং জান্নাতের পুরো সময়টি হবে বসন্ত। যারা পৃথিবীর ভোগবিলাসে মগ্ন না হয়ে আল্লাহর প্রেমে মগ্ন থাকে, শুধু তারাই জান্নাতে সেই চির বসন্তের স্বাদ উপভোগ করার তাওফিক লাভ করবেন।

Advertisement

আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় বান্দাদের জান্নাতে চিরকাল বসন্তে থাকার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে তিনি ইরশাদ করেন-

- ‘মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের এমন সব বাগানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যেগুলোর পাদদেশ দিয়ে নদনদী বয়ে যাবে। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর তিনি তাদের চিরস্থায়ী বাগানসমূহে পবিত্র ঘরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে সবচেয়ে বড় হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি। এটাই মহান সফলতা।’ (সুরা তাওবাহ : আয়াত ৭১)

- ‘আর যাদের সৌভাগ্যবান সাব্যস্ত করা হয়েছে তারা জান্নাতে থাকবে। আকাশসমূহ ও পৃথিবী যতদিন স্থায়ী থাকবে তারা সেখানে ততদিন অবস্থান করবে। তবে তোমার প্রভু-প্রতিপালক অন্য কিছু চাইলে সে কথা ভিন্ন। এ হবে এক নিরবচ্ছিন্ন দান।’ (সুরা হুদ : আয়াত ১০৮)

জাহান্নাম সম্পর্কে বলা হয়েছে-

Advertisement

কুরআনুল কারিমের ঘোষণা অনুযায়ী জান্নাত বা বেহেশত চিরস্থায়ী হবে, তবে দোজখ বা জাহান্নামের শাস্তি চিরস্থায়ী নয় বরং ক্ষণস্থায়ী। হাদিসে এসেছে-

হজরত আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জাহান্নামের ওপর এমন এক সময় আসবে যখন এর দরজাগুলো বাতাসে খট খটাতে থাকবে  এবং এর মধ্যে কোনো লোক অবশিষ্ট থাকবে না। এর অধিবাসীরা এতে বহু শতাব্দী থাকবার পর এমন ঘটবে। (মুসনাদে আহমাদ)

এই হাদিস অনুযায়ী জাহান্নাম সম্বন্ধে ‘খালেদিনা’ শব্দ শত শত বছর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এ ব্যাপারে হজরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর, হজরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হজরত ইমাম হাম্বল রাহমাতুল্লাহিও একমত প্রকাশ করেছেন। হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ বুখারিতে হজরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহুও একই হাদিস বর্ণনা করেছেন।

বিখ্যাত ওলামায়ে কেরামদের মধ্যে ইবনে তাঈমিয়া এবং ইবনে কাইয়্যিম লিখেছেন ‘যদিও দুষ্ট প্রকৃতি বিশিষ্ট অবিশ্বাসীদের চিরকাল জাহান্নামে থাকা উচিত, একদিন আল্লাহর অসীম করুণাবলে দোজখই অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে এবং যখন জাহান্নামই থাকবে না তখন এর নিবাসীও থাকবে না।’ (ফাতহ)

জান্নাত সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-

জান্নাতের পুরস্কার কখনো শেষ হবে না কিন্তু জাহান্নাম সম্পর্কে এ ধরণের কোন শব্দাবলী পাওয়া যায় না। তাই এ কথা স্পষ্ট যে আল্লাহ তাআলার জান্নাত হচ্ছে চির বসন্ত। সেখানে সবসময় বসন্তের আবহ বিরাজ করবে। আল্লাহ তাআলার জান্নাতের বাগান কতই না চমৎকার হবে! যেখানে বছরের বার মাসই বসন্ত আর এর সৌন্দর্য আমাদের ভাবনার উর্ধ্বে।

জান্নাত বা বেহেশতের আরাম আয়েশ ও সুখ স্বাচ্ছন্দ সম্পর্কে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি আমার নেক বান্দাদের জন্য এত নেয়ামত তৈরি করেছি যে, কোনো চোখ তা দেখেনি, কোনো কান তা শুনেনি, বরং কোনো মানুষের হৃদয়েও তার ধারণা জন্মেনি।’ (বুখারি)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস অনুযায়ী পরকালীন জীবনের অনুগ্রহসমূহ দুনিয়ার বস্তুর মতো নয়। ধর্মপরায়ণ ও বিশ্বাসী মুমিন ব্যক্তিদের দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি সৎ কাজের জন্য আধ্যাত্মিক তৃপ্তিদায়ক আশীর্বাদরূপে তাদের সামনে উপস্থিত করা হবে। আল্লাহ তাআলার নেক বান্দাদের তিনি সেদিন এমন এমন পুরস্কার প্রদান করবেন, যা মানুষ দুনিয়াতে কল্পনাও করতে পারে না।

আল্লাহ তাআলার এই চির বসন্তের বাগানে কেবল শান্তি প্রাপ্ত আত্মারাই বিচরণ করবে। যেভাবে কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

- ‘হে শান্তিপ্রাপ্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রভু-প্রতিপালকের দিকে সন্তুষ্ট হয়ে এবং তাঁর সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে আস। অর্থাৎ তুমি আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।’ (সুরা ফাজর : আয়াত ২৭-৩০) 

- ‘তিনি তাদের এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার নিচ দিয়ে নদনদী বয়ে যায়। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। তাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। এরাই আল্লাহর দল। সাবধান! আল্লাহর দলই সফল হবে।’ (সুরা মুজাদেলা : আয়াত ২২)

মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির উচ্চতম পর্যায় হচ্ছে, সে তার প্রভুর ওপর পূর্ণভাবে সন্তুষ্ট এবং তার প্রভুও তার প্রতি সন্তুষ্ট আর এই পর্যায়ে যখন মুমিনের আত্মা উপনীত হয় তখনই আল্লাহ তাআলা তাকে চিরকাল বসন্ত বিরাজমান জান্নাতে বসবাসের জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন-

 ‘এরাই জান্নাতের অধিবাসী। এদের কৃতকর্মের প্রতিদান হিসেবে এরা সেখানে চিরকাল থাকবে।’ (সুরা আহকাফ : আয়াত ১৪)

আসলেই ‘শান্তিপ্রাপ্ত আত্মা’র অবস্থা হলো জান্নাতি অবস্থা, যে অবস্থায় সে সকল মানবীয় দুর্বলতা ও দোষের উর্ধ্বে উঠে যায় এবং এক অপূর্ব আধ্যাত্মিক শক্তিতে শক্তিমান হয়ে ওঠে। সে আল্লাহর সঙ্গে একীভূত ও বিলীন হয়ে যায়। আল্লাহ ছাড়া সে বাঁচতেই পারে না।

এই যে পরিবর্তন তা কিন্তু দুনিয়াতে নেক আমল করার ফলেই তার মাঝে ঘটে, যার ফলে দুনিয়াতেই সে চির বসন্তের জান্নাতে প্রবেশের অধিকার পেয়ে যায়। আর এই ধরণের প্রশান্ত হৃদয়ের অধিকারীকে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মৃত্যুর আগেই বলা হবে-

‘হে শান্তিপ্রাপ্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রভু-প্রতিপালকের দিকে সন্তুষ্ট হয়ে ও তার সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে আস।’

আমরা যদি সৃষ্টিকর্তার জান্নাতের চির বসন্তের স্বাদ পেতে চাই তবে সবাইকে শান্তিপ্রাপ্ত আত্মার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। এজন্য আমাদের সব ধরনের অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে আল্লাহ তাআলার নির্দেশিত পথে থেকে নিজেদের জীবন পরিচালিত করতে হবে। বিনিময়ে মহান আল্লাহ বান্দাকে দান করবেন চিরস্থায়ী বসন্ত ও শান্তির স্থান জান্নাত। আল্লাহ তাআলা কবুল করুন। আমিন।

এমএমএস/জেআইএম