দেশজুড়ে

কুমিল্লার প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে ছিল পাকবাহিনীর বাধা-হুমকি

১৯৫২ সালে রক্তের বিনিময়ে ভাষার দাবি পূরণ হলেও কুমিল্লায় শহীদ মিনার নির্মাণে ছিল পাকবাহিনীর বাধা ও হুমকি। কিন্তু কুমিল্লার অকুতোভয় ও অদম্য শিক্ষার্থীরা পিছু হটেনি। প্রথমে অস্থায়ী এবং পরে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসে।

Advertisement

‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ থেকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’- এ দুই ক্ষেত্রেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ভাষাসংগ্রামী কুমিল্লার দুই সন্তান। এদের মধ্যে ১৯৪৮ সালে কংগ্রেস দলের প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১) সর্বপ্রথম পাকিস্তান গণপরিষদে মাতৃভাষা বাংলার দাবি উত্থাপন করেন। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম আর রক্তের বিনিময়ে ভাষার দাবি বাস্তবায়িত হয়। পরবর্তীতে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণার দাবি জানিয়ে সর্বপ্রথম ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে আবেদন করেন কানাডা প্রবাসী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম। পরবর্তীতে এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বাংলা ভাষা আজ জাতিসংঘের ১৯০টি সদস্য দেশসহ বিশ্বময় সমাদৃত।

প্রথম শহীদ মিনার

কুমিল্লায় প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয় শহরের কান্দিরপাড়স্থ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে। মহান মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের পূর্বাঞ্চলের ইয়ুত ট্রেনিং কন্ট্রোল বোর্ডের পরিচালক ও প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক দেবব্রত দত্ত গুপ্ত বলেন, ‘ভাষার দাবি পূরণের পরও ওই সময়ে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের মতো কোনো সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল না। তাই উল্লেখ করার মতো শহীদ মিনার ছিল না। ১৯৫২ সালে ভাষা নিয়ে আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয় আসার পর কুমিল্লার প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে। ১৯৫৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শাখায় শহীদ মিনারটি অস্থায়ীভাবে তৈরি করা হয়। ধারাবাহিকভাবে তিনবার পুলিশ শহীদ মিনার ভেঙে দেয়। তবে অদম্য ছাত্রদের চেষ্টা থেমে থাকেনি।’

Advertisement

অধ্যাপক দেবব্রত দত্ত গুপ্ত আরও বলেন, ‘ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ১৯৬৩ সালে শহরের রানীর দীঘির পশ্চিম পাড়স্থ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ক্যাম্পাস অভ্যন্তরের পুকুর পাড়ের আমতলায় কলেজ কর্তৃপক্ষ কালো শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে। পরে তৎকালীন সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ১৯৭১ সালে কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. সিরাজুল ইসলাম শহীদ স্মৃতি স্তম্ভখানা পার্শ্ববর্তী পুকুরের (বর্তমানে ভরাট) পানিতে নিমজ্জিত করে রাখেন। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শহীদ স্মৃতি স্তম্ভখানা পুকুর থেকে উত্তোলন করা হয় এবং কলেজ ক্যাম্পাস থেকে স্থানান্তর করে মূল ফটকের সামনের রানীর দীঘির পশ্চিম পাড়ে স্থাপন করা হয়। সেখানে কুমিল্লা নগরবাসী ২১ ফেব্রুয়ারিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন।’

এদিকে ২০১৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শাখার শহীদ মিনারটিকে মূলস্তম্ভ ঠিক রেখে স্থানীয় সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজি আ ক ম বাহাউদ্দিনের উদ্যোগে কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর আবদুর রশিদ সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধন করেন।

এর আগে ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে নগরীর কেন্দ্রস্থল কুমিল্লা টাউন হল মাঠের পূর্ব-উত্তরাংশে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। এর ঠিকাদার ও জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাবলু জানান, দৃষ্টিনন্দন করে নির্মিত এ শহীদ মিনারে ১৯৯১ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্যদিয়ে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এতে ভিক্টোরিয়া কলেজের রানীর দীঘির পশ্চিমপাড়ের প্রথম শহীদ মিনারটি ‘ভিক্টোরিয়া কলেজ শহীদ মিনার’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত

Advertisement

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে কংগ্রেস দলের প্রতিনিধি কুমিল্লার সন্তান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য দাবি উত্থাপন করেন। তার সেই দাবিতে ক্রমে উত্তাল হয়ে উঠে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। তার নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণায় ছাত্র-জনতা ২ মার্চ কুমিল্লার জেলা ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে প্রতিবাদ সভা করে।

১১ মার্চ প্রতিবাদ সভা ও ধর্মঘট পালন এবং ২৩ ডিসেম্বর টাউন হলে প্রতিবাদ সভা করা হয়। কুমিল্লায় গঠন করা হয় সর্বদলীয় ভাষাসংগ্রাম কমিটি ও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। তমুদ্দুন মজলিস-কুমিল্লা শাখার উদ্যোগে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত উত্তাল আন্দোলনের মধ্যেও ভাষা দিবস পালন করা হয়। আন্দোলন ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে জেলার দাউদকান্দি, লাকসাম, চান্দিনা, বুড়িচং ও মুরাদনগরসহ বিভিন্ন এলাকায়। ১৯৫২ সালের ৯ মার্চ পর্যন্ত কুমিল্লায় কবি শহিদুল্লাহ ও মোহাম্মদ উল্লাহসহ রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাদের মধ্যে ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে কুমিল্লায় আন্দোলন-সংগ্রামে রাজনীতিক ও ছাত্রনেতাদের মধ্যে যারা নেতৃত্ব দেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন-তৎকালীন সর্বদলীয় ভাষাসংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক সিহাব উদ্দিন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক মোহাম্মদ উল্লাহ্, কবি ও সাংবাদিক মোহম্মদ শহিদুল্লাহ্, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী, ভিক্টোরিয়া কলেজের তৎকালীন ভিপি মহিব উল্লাহ, জিএস অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট আহমদ আলী, ওয়াজি উল্লাহ্, অধ্যাপক আশরাফ উদ্দিন, আবদুস সহিদ ইসহাক, আলী তাহের মজুমদার, জিয়াউল হক, ফয়েজ উল্লাহ, প্রফেসর আবুল খায়ের, প্রফেসর ফাতেমা খায়ের, বজলুল হুদা চৌধুরী, জহিরুল হক (লিল মিয়া) ও শফিউল হক প্রমুখ।

মো. কামাল উদ্দিন/এসআর/এএসএম