কৃষি ও প্রকৃতি

চায়না কমলা চাষে ওমর ফারুকের সফলতা

চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চল নিধিকুন্ড গ্রাম। জেলা শহর থেকে গ্রামটির দূরত্ব প্রায় ৩২ কিলোমিটার। এখানেই ওমর ফারুকের ৫ বছর বয়সী মনোমুগ্ধকর চায়না কমলার বাগান। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা র্প্রন্ত গোটা বাগানের চারপাশে উৎসুক দর্শনার্থীর ভিড় লেগেই থাকে। দূর থেকে দেখে মনে হবে এটা একটা পর্যটন কেন্দ্র।

Advertisement

এ সবকিছুই কৃষক ওমর ফারুকের কমলা বাগান ঘিরে। ওই কমলার বাগানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই এসেছেন ওখানে। তারা সবাই কমলার চারা কিনছেন। চাইনিজ (চায়না) কমলা চাষ করে বড় ধরনের সফলতা পেয়েছেন ওমর ফারুক নামের ওই কৃষক।

গত বছর তিনি শুধু কমলার চারাই বিক্রি করেছেন ৫০ লাখ টাকার। এ বছরও তিনি ৫০ লাখ টাকার চারা বিক্রি করবেন বলে আশা করছেন। বাগান ঘুরে দেখা যায়, বাগানের প্রতিটা গাছে নতুন করে ফুল আসতে শুরু করেছে। আর কিছুদিন পরই তা ফলে পরিণত হবে।

জেলার জীবননগর উপজেলার নিধিকুন্ড গ্রামের এক সময়ে সবজির আবাদ করতেন কৃষক ওমর ফারুক। বছর দশেক আগে সবজি চাষের পাশাপাশি অনাবাদি জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তিনি গড়ে তোলেন নার্সারি। এরপর থেকেই তার নেশা জাগে নতুন ফলের বাগান করা। ওই নেশা থেকেই তিনি চায়না কমলা লেবুর চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এলাকাবাসীর। রীতিমতো সারা দেশে চমকও সৃষ্টি করেছেন তিনি।

Advertisement

গল্পের শুরুটা ২০১৫ সালের শেষ দিকে। ওমর ফারুক এক বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল খুলনাতে। সেখানে গিয়ে একটি বাড়ির আঙিনায় চায়না কমলার গাছ দেখতে পান তিনি। সেখান থেকেই ১০টি ডগা সংগ্রহ করে বাড়িতে নিয়ে কলম করেন। পরে সে চারা থেকে কলমের মাধ্যমে আরও চারা উৎপাদন করেন তিনি। পরের বছর শুরু করেন গাছের চারা রোপণের কাজ। নার্সারির পাশে নিজের পতিত ১ বিঘা জমিতে ১০০টি গাছের চারা রোপণ করেন এই কমলা চাষি।

সঠিক পরিচর্যার পর ২ বছরের মাথায় ২০১৮ সালের নভেম্বরে গাছে কমলা ধরে। এ কমলা অবিকল চায়নার কমলার মত দেখতে এবং রঙ ও স্বাদে একই রকম। ওই বছর তিনি আড়াই লাখ টাকার কমলা বিক্রি করেন এবং বাণিজ্যিকভাবে বাগান গড়ার জন্য ৩০ হাজার কলম চারা বাঁধেন। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ওমর ফারুককে। বর্তমানে এই কমলার বাগানের কারণে দেশব্যাপী বেশ পরিচিতিও লাভ করেছেন ওমর ফারুকের খান নার্সারি।

কমলা চাষি ওমর ফারুকের ছেলে ইমরান খাঁন আকাশ জানান, চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি তাদের বাগানের কমলা বিক্রি শেষ হয়েছে। প্রায় ৭ লাখ টাকার কমলা বিক্রি করেছেন। এছাড়া যে সমস্ত দর্শনার্থী বাগান পরিদর্শনে এসেছেন তারা বাগান থেকে নিজ হাতে ছিড়ে কমলা খেয়েছেন। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন যায়গা থেকে চাষিরা এসে কমলার চারা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। শুধু দেশেই না ভারত থেকেও এক চাষি মোবাইল ফোনে ১০ হাজার চারা কেনার বায়না দিয়েছেন।

কমলা চাষি ওমর ফারুক বলেন, খুলনায় বন্ধুর আত্মীয়ের বাড়ি থেকে কমলা গাছের ডগা কেটে এনে কলম তৈরি করার পর গাছের চারা উৎপাদন করি। এরপর ৩৩ শতক জমিতে ওই ১০০টি কমলা গাছ রোপণ করার দু'বছরের মাথাই ফল ধরা শুরু করে। প্রথম বছর প্রতি গাছে ৫-১০ টি করে কমলা ধরেছিল। পরের বছর প্রতি গাছে ২০ থেকে ৩০ কেজি, তৃতীয় বছর প্রতি গাছে কমলা এসেছে ৮০ থেকে ৯০ কেজি এবং এ বছর প্রতিগাছে কমলা এসেছিল ১০০ থেকে ১৩০ কেজি পর্যন্ত।

Advertisement

তিনি আরও জানান, কমলা চাষে কম খরচে অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব। একটি গাছে গড়ে প্রায় ১০ হাজার টাকার কমলা বিক্রি করা সম্ভব। এ হিসেবে এক বিঘা জমিতে উৎপাদিত কমলা বিক্রি করে সব খরচ বাদে বছরে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। এ জাতের কমলার চাষ করতে তিনি সকল কৃষকদের উৎসাহিত করছেন। এ জাতের কমলা সারাদেশে চাষ হলে বিদেশ থেকে কমলা আমদানি করার প্রয়োজন অনেকাংশে কমে যাবে। তার বাগানে যে কমলা উৎপাদন হচ্ছে তা খুব সুন্দর এবং খেতেও কড়া মিষ্টি।

স্থানীয় গ্রামবাসী সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মির্জা তাহাজ্জত হোসেন জানান, চাইনিজ কমলা। যা গত কয়েক বছর আগেও দেশের কৃষকদের কাছে ছিল স্বপ্নের মতো। আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন নিধিকুন্ডু গ্রামের কৃষক ওমর ফারুক। নিজের নেশা থেকে নতুন ফল উৎপাদন করার প্রচেষ্টায় চায়না কমলার বাণিজ্যিক চাষ করেছেন তিনি। প্রচেষ্টা থেকে তা আজ বড় সফলতায় রূপ নিয়েছে। রীতিমত সারাদেশে চমক সৃষ্টি করেছেন তিনি।

এই কমলা বাগানের খবর পেয়ে দর্শনার্থীরা ভিড় জমান প্রতিনিয়িত এবং দর্শনার্থীরা কমলা ছুঁয়ে ছবি তুলতে আসেন। এমকি ভারতের কোলকাতা থেকেও দর্শনার্থী এসেছেন কমলা বাগান দেখতে। কমলা বাগানের ভেতর গেলে মনে হয়, 'চীন অথবা ভারতের দার্জিলিংয়ের কমলা বাগান পরিদর্শন করছি।'

কমলার চারা কিনতে আসা মজিবর রহমান জানান, আমি বৃক্ষপ্রেমী। বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে আমার বাগানে। এখানকার কমলা বাগানের কথা শুনে দেখতে এসেছি এবং অভিজ্ঞতা নিতে এসেছি। নিজের একটা কমলা বাগান করার ইচ্ছা আছে। জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার জানান, কৃষক ওমর ফারুকের কমলার বাগানে তিনি একাধিকবার গিয়েছেন। কমলা চাষে সফল ওমর ফারুক এখন অনেকের কাছে উদাহরণ। কৃষি বিভাগ সবসময়ই এ ধরনের ভিন্ন জাতের ফসল উৎপাদনে সাহায্য-সহযোগীতা করে আসছে। ওমর ফারুকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

এই অঞ্চলে কমলা চাষের একটি সম্ভবনা তৈরি হয়েছে। যা এই অঞ্চলের কৃষিকে সমৃদ্ধ করবে। তিনি বলেন, যে কমলা দেশে বর্তমানে চাষ হচ্ছে সেগুলোর চেয়ে এ কমলা স্বাদে অনেক ভালো। আর আমদানিকৃত কমলার চেয়ে এ কমলার রঙটাও আকর্ষণীয়। বর্তমানে জীবননগর উপজেলায় ১০ হেক্টর জমিতে এই জাতের কমলার চাষ করেছেন কৃষকরা। জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম মুনিম লিংকন বলেন, দেখতে চায়না কমলা-লেবুর মতো হলেও স্বাদে খানিকটা এগিয়ে আছে। ব্যতিক্রম স্বাদের এ কমলা চাষে হাসি ফুটেছে কৃষক ওমর ফারুকের মুখে। নিঃসন্দেহে কৃষক ওমর ফারুক একজন সফল কৃষক।

সালাউদ্দীন কাজল/এমএমএফ/এমএস