সরকারিভাবে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি পেলেও বৈষম্যের শিকার হয়ে বিবর্ণ জীবন কাটছে হিজড়াদের। আজও বদলায়নি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, বদলায়নি তাদের ভাগ্য। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সর্বত্র কেবল অপমান, উপহাস, তাচ্ছিল্য আর নিগ্রহের শিকার অধিকাংশ হিজড়াদের দিন কাটে ভিক্ষাবৃত্তিতে। তবে এই ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বেরিয়ে এসে তারাও সমাজের অন্য দশজনের মতোই স্বাভাবিক জীবন ফিরে যেতে চান।
Advertisement
ক্লেদ, দুঃখ ও বঞ্চনাকে সঙ্গী করে এগিয়ে চলা এসব তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাও স্বপ্ন দেখেন দিন বদলের। কর্মসংস্থান আর বাসস্থানের ব্যবস্থা হলেই বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজে পাবেন এমটাই বিশ্বাস তাদের।
এদেরই একজন নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার অপু। ১৯৯৫ সালের ৫ ফেব্রয়ারি মায়ের কোল আলোকিত করে জন্ম নেয় অপু। কিন্তু কে জানবে এ জন্মই তার আজন্ম পাপ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে সে। স্রোতের বিপরীতে চলতে থাকা অপু এক সময় হার মানে এই সমাজ-সংস্কৃতির কাছে।
স্থানীয় একটি স্কুল থেকে এসএসসি এবং কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর রংপুর সরকারি কলেজে অর্থনীতি বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন। তৃতীয়বর্ষ পর্যন্ত পড়াশেখা করলেও আর এগুতে পারেননি। স্নাতক সম্পন্ন করতে পারলেও তৃতীয় লিঙ্গের হওয়ায় অপুর কপালে জোটেনি কোনো চাকরি।
Advertisement
১২-১৩ বছর আগে নিজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা অপুর এখন দিন চলে ভিক্ষাবৃত্তি করে। সকাল হলেই বেরিয়ে পড়তে হয় জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে। তবে এ জীবন তিনি চান না।
অপু জানান, লেখাপড়া শিখেও কোনো চাকরি জোটেনি। চাকরির পরীক্ষা দিতে গেলে হিজড়া পরিচয় জানার পর তাকে বাদ দিয়ে অন্যকে সুযোগ দেয়া হয়েছে। কারও করুণা দিয়ে নয়, কর্মসংস্থানের সুযোগ পেলে নিজের যোগ্যতায় তিনি বেঁচে থাকতে চান।
অপুর মতোই আরও একজন মাসুদ থেকে নিজের নাম দিয়েছেন দোলা। মা-বাবার একমাত্র সন্তান হয়েও ঠাঁই মেলেনি পরিবারে। এসএসএসি পাস করে রংপুর পলিটেকনিক্যালে ভর্তি হলেও শেষ পর্যন্ত পড়ালেখা করা হয়ে ওঠেনি তার। নগরীর নুরপুরে অপুর সঙ্গে তিনিও ভাড়াবাসায় বসবাস করছেন, বেছে নিয়েছেন ভিক্ষাবৃত্তি।
অপু-দোলার মতো এমন অনেক শিক্ষিত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ কেবল একটি উদার সমাজ নির্মাণের প্রত্যাশা করেন। যেখানে লিঙ্গ-বৈষম্যের শিকার হবে না কেউ।
Advertisement
রংপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের তথ্য মতে, রংপুর জেলায় ৩৭০ জন তালিকাভুক্ত হিজড়া রয়েছেন। যার অধিকাংশই বিভিন্ন উপজেলা ও জেলা শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করছেন। তালিকাভুক্ত ৩৭০ জন হিজড়ার মধ্য থেকে ১৮০ জনকে বিভিন্ন ট্রেডে (সেলাই, রান্না, কম্পিউটার, পার্লার, মোবাইল-রেডিও-টেলিভিশন সার্ভিসিং) প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
রংপুরের তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীর দলনেতা আনোয়ারুল ইসলাম রানা বলেন, তালিকাভুক্ত ৩৭০ জন হিজড়ার মধ্যে হাতেগোনা ১৪/১৫ জন বিভিন্ন কর্মসংস্থানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেও দেড়শতাধিক হিজড়া বেছে নিয়েছেন ভিক্ষাবৃত্তি। বাকিরা পরিবারের সঙ্গে থেকে পড়ালেখা করছেন। কেউবা বেকার হয়ে ঘুরে বেড়ান।
প্রশিক্ষণ শেষে দশ হাজার করে টাকা দেয়া হলেও তা পর্যাপ্ত না। একটা পার্লার বা সার্ভিসিং সেন্টার দিতে হলে অনেক টাকার প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনীয় মূলধন না থাকায় বাধ্য হয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে থেকে গেছেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা।
রানা বলেন, সরকারিভাবে বিভিন্ন ভাতা চালুর কথা বলা হলেও ৩৭০ জন হিজড়ার মধ্যে মাত্র দু’জন বয়স্ক ও ১২ জন শিক্ষা ভাতা পাচ্ছেন। যা দিয়ে জীবনধারণ করা সম্ভব না।
কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। অনেক কষ্টে নগরীর নুরপুরে তিন রুমের একটি পুরোনো স্যাঁতসেঁতে জরাজীর্ণ বাড়ি ভাড়া নিয়ে ২০/২২ জন গাদাগাদি করে থাকছেন। অন্য এলাকাতেও হিজড়াদের এভাবেই দিন কাটছে।
রানা আরও বলেন, বাসস্থানের জন্য দীর্ঘদিন ধরে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। কেবল আশ্বাসই মেলে। সরকার ভূমিহীন-গৃহহীনদের ঘর দিচ্ছে, রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ নিয়েছে। আমরাও পুনর্বাসন-কর্মসংস্থান চাই। কর্মস্থান ও বাসস্থানের সুযোগ পেলে হিজড়ারাও বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজে পেত।
রংপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আব্দুল মতিন বলেন, কোনো শ্রেণির মানুষই যেন পিছিয়ে না পড়ে এজন্য বর্তমান সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এরই লক্ষ্যে ২০১৩ সাল থেকে সমাজসেবা অধিদফতরের আওতায় বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ইতোমধ্যে রংপুর জেলার তালিকাভুক্ত ৩৭০ জন হিজড়ার মধ্য থেকে বিভিন্ন ট্রেডে ১৫০ জনকে পঞ্চাশ দিন এবং ৩০ জনকে ১২ দিন মেয়াদী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জন বিভিন্ন কর্মসংস্থানে যুক্ত হয়েছেন। হিজড়াদের প্রশিক্ষণের আওতায় এনে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, কিছু হিজড়াকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। এরমধ্যে কয়েকজন কর্মসংস্থানে জড়িয়ে পড়েছেন। পর্যায়ক্রমে তাদের কর্মসংস্থানের বিষয়ে আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, সিটি কর্পোরশেনের ভেতরে তাদের বাসস্থানের জন্য প্ররিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালককে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। উপ-পরিচালকসহ হিজড়া জনগোষ্ঠীর কয়েকজনকে নিয়ে জায়গা পরিদর্শন করা হবে। যদি তারা সেখানে থাকতে আগ্রহী হয় তাহলে প্রাথমিক পর্যায়ে একসঙ্গে ২০ জনের থাকার ব্যবস্থা করা যাবে। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ে যে ইউনিয়নগুলোতে আমাদের ঘর আছে তারা সেখানে একসঙ্গে থাকতে চাইলে দেয়া হবে।
জিতু কবীর/এফএ/এমএস