বর্তমানে করোনা মহামারির কারণে আমরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, অনলাইন প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে অনেক কিছু চালু রাখতে সক্ষম হয়েছি। গোটা বিশ্বের শিক্ষার্থীরা মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের মাধ্যমে পড়াশোনা করছে। পৃথিবীর সর্বত্রই যে বিষয়টি বেশি লক্ষণীয় ছিল সেটা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করার পরিকল্পনা।
Advertisement
এই পরিকল্পনায় দেখা গেছে ‘‘the last thing was to close Schools’’ আবার এখন যে আলোচনা চলছে গোটা বিশ্বে তাতে মনে হচ্ছে ‘‘the first thing will be to open Schools.’’ এই সিদ্ধান্তে গোটা বিশ্ব একমত হলেও সুইডেন কিছুটা আলাদা পথ বেছে নেয় প্রথম থেকেই। করোনার সময় স্কুল বন্ধ করে ঘরে বসে প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র প্রযুক্তির কারণে এবং এর সঠিক ব্যবহার করা হয়েছে অনলাইনের মাধ্যমে।
প্রশিক্ষণকে চালু রাখা হয়েছে যার ফলে বিশ্ব তরুণ সমাজ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়নি। তবে যা থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে সেটা হলো ফেস ট্যু ফেস ইন্টাঅ্যাকশন ইন বিটুইন টিচার অ্যান্ড স্টুডেন্টস। এখন অনলাইনে লেখাপড়া কতটুকু হচ্ছে শুধু সেটা বিচার করলে হবে না। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাও ভেবে দেখা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। ক্লাস করার নাম নিয়ে অনেকে সারাদিন অনলাইন ঘাটছে।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্বজনদের বিচ্ছিন্নতাও বাড়ছে। অনেকেই কঠিন মানসিক ও শারীরিক অবসাদে ভুগছে, উদ্বিগ্ন থাকছে, একাগ্র মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছে। অনলাইনে ক্লাস করাটা অনেকের কাছে ভীতির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাড়ছে মানসিক সংকট এবং অনেকে হয়ে পড়ছে আতঙ্কগ্রস্ত। এর ফলে অত্যধিক মানসিক ও শারীরিক চাপ আর অবসাদ সৃষ্টি হচ্ছে, যা শিক্ষার মূল প্রকৃতি, প্রেষণা ও উদ্যোগকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করছে।
Advertisement
দীর্ঘদিন ধরে প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার কারণে মানসিক ও শিখন-সমস্যারও দেখা দিয়েছে। এতে করে পারিবারিক সম্পর্কের ভারসাম্য বিরাট বিপর্যয়ের মুখে। সর্বোপরি অকালবয়স্ক শিক্ষার্থীরা ঝুঁকে পড়ছে সাইবার সেক্সুয়ালের দিকে।
একই সঙ্গে প্রতিনিয়তই উন্নতমানের প্রযুক্তির চাপ বেড়ে চলেছে। যেমন সুইডেনের কথা ধরা যাক। এখানে আমরা এমন দুনিয়ায় বসবাস করছি যেখানে কী করি, কী পরি, কী পড়ি, কাকে ভালোবাসি, এমনকি কীভাবে ভালোবাসি, কখন কোথায় যাই, কার সঙ্গে যাই সবকিছুর ওপরে নজর রাখা সম্ভব। যখন যা করছি, বলছি কম্পিউটার, মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপে তা মনিটর করা খুবই সহজ।
ফেসবুক, টুইটার, গুগল ম্যাপ, জিপিএস তো আমাদের অনুসরণ করে, বিশ্লেষণ করে, আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে। গুগল ম্যাপে নিজের বাড়ির ছবি দেখা যায়, স্যাটেলাইট থেকে কোন বাড়িতে কে ঢুকছে, কে বেরোচ্ছে সবই দেখা যাচ্ছে। তারপর রয়েছে আমাদের চারদিকে সিসিটিভি যা সহজ উপায়ে ভিসা কার্ডের কোড নকল করে টাকা তুলে নিচ্ছে। এসব এখন শুধু সুইডেনে নয় বাংলাদেশেও সম্ভব।
উল্লিখিত বিষয়গুলো শারীরিক ও মানসিক অশান্তি বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট। তাহলে সমাধান কী?
Advertisement
গত দীর্ঘ চল্লিশ বছর কঠিন পরিশ্রম, ডেডিকেশন, ইনভেস্টিগেশন, মোটিভেশন এবং ইনোভেশনের বিনিময়ে মানবজাতি পেয়েছে প্রযুক্তির এই ব্যবহার। যার ফলে সম্ভব হয়েছে করোনা মহামারির সময় অনেক কিছু ম্যানেজ করে চলতে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রোগ জীবাণুরও আবির্ভাব ঘটে যা সত্যি বিস্ময়কর। কারণ করোনা মহামারি চল্লিশ বছর আগে পৃথিবীতে আসেনি, এসেছে প্রযুক্তির যুগে। বর্তমানে প্রযুক্তির কারণে যে সুযোগ সুবিধা আমরা পেয়েছি তার চেয়েও শতগুণ বেশি সুযোগ পেতে পারি যদি আমরা এখন এর সঠিক ব্যবহার করি। যেমন সিস্টেম ইন প্লেস তার মধ্যে অন্যতম। সে আবার কী? শত শত উদাহরণ দিতে পারবো এর ওপর।
যেমন ক্যাশ টাকার ব্যবহার না করে অনলাইন পে সিস্টেম চালু করা। প্রত্যেক নাগরিকের জন্মনিবন্ধনকে সিস্টেমাইজ করে নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া। গণতন্ত্রের বেস্ট প্র্যাক্টিস এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা। ট্যাক্স পদ্ধতির আধুনিকায়ন করা। রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা সুসংহত করা। প্রশাসনের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের ফলোআপ করা থেকে শুরু করে সমাজের সমস্ত পরিকাঠামোর তদারক করা যা দিতে পারে একটি দু্র্নীতিমুক্ত, কলুষমুক্ত ও দুষণমুক্ত সমাজ, দেশ ও বিশ্ব। সমাজে যারা মাদকাসক্ত তারা শুধু মদ খায় কিন্তু যারা দুর্নীতি করে বা ঘুষ খায় তারা কিন্তু সবই খায়। কারণ দুর্নীতির টাকা কখনও হালাল হতে পারে না। আর সে টাকা দিয়ে মদের পরিবর্তে যদি দুধও কেনা হয় তাহলে সে দুধের সঙ্গে মদের কোনো নৈতিক তফাৎ আছে বলে আমি মনে করিনা। যদি প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতি দমন করা যায় তবে হালাল অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে হালাল খাবার খাওয়া সম্ভব। আমি মনে করি শত শত সমস্যার সমাধান না করে শুধু দুর্নীতির সমাধান যদি করা যায় তবে শত শত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
আমরা যেমন গাড়ি চালানোর সময় প্রতিটি কম্পোনেন্টের দিকে নজর দেই না। নজর থাকে শুধু গাড়ির গতির দিকে, হঠাৎ গাড়িতে সমস্যা দেখা দিলে ডিসপ্লেতে সেটা দেখা যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে আমরা সমাধান করি সমস্যার। এটা সম্ভব কারণ গাড়িতে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করে সিস্টেম ইন প্লেস চালু করা আছে।
এখন প্রযুক্তির সর্বাঙ্গীন ব্যবহার করে সমাজ, দেশ এবং বিশ্বের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে। সেক্ষেত্রে শুধু প্রযুক্তির উপর অ্যাট্রাকশন বাড়ালে হবে না নিশ্চিত করতে হবে মানবজাতির ইন্টারাকশন। অ্যাট্রাকশন এবং ইন্টারাকশনের সমন্বয়ে যে সমাজ গড়ে উঠবে সেটা হবে রোল মডেল ফর দি কোয়ালিটি লাইফ। দি সুনার দ্য বেটার।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com
এমআরএম/এএসএম