সাহিত্য

জীবনানন্দের কবিতায় প্রকৃতি ও দেশজ উপাদান

দেশজ ও গ্রামীণ উপাদানে শব্দবুননের মাধ্যমে কবি জীবনানন্দ দাশ কবিতাকে গতিশীলতা দিয়েছেন। কবিতায় উঠে-আসা মাটিগন্ধি উপাদান পাঠকপ্রিয়তা পেতে সাহায্য করেছে। ‘সেইদিন এই মাঠ’ কবিতাংশ দিয়েই আলোচনা শুরু করতে পারি, ‘...আমি চ’লে যাব ব’লে/চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে/নরম গন্ধের ঢেউয়ে?/লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মীটির তরে?/সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!/চারিদিকে শান্ত বাতি- ভিজে গন্ধ- মৃদু কলরব;/খেয়ানৌকাগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;/পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে র’বে চিরকাল;-/এশিরিয়া ধুলো আজ-ব্যাবিলন ছাই হ’য়ে আছে’।

Advertisement

জীবনানন্দের কবিতায় একটা জিনিস প্রচুর লক্ষ্য করা যায়; সেটি হচ্ছে ‘ড্যাস’র ব্যবহার। চিত্রকল্প নির্মাণে কবি প্রচুর ড্যাসের ব্যবহার করেছেন। দুটি পর্বকে সম্মিলন ঘটাতে তাঁর জুড়ি নেই। বাড়ির আশেপাশের উপাদান ব্যবহারে কবি সিদ্ধহস্ত। উপমা প্রয়োগের ক্ষেত্রে দেশজ উপাদানের কাছে হাত পেতেছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে সফলতায় অনন্য হয়েছেন। অনেক শব্দ বা জিনিস আমাদের আশেপাশেই আছে; আমরা হয়তো তা খেয়াল করি না। অন্য কবিরা সাহিত্যে তুলে আনতে চাননি বা সফল হননি। উপমার বস্তু যে আমাদের দেশেই আছে এবং ধারে-কাছেই আছে, তা কবিতায় প্রয়োগের মাধ্যমে দেখিয়েছেন।

কবি জীবনানন্দ দাশের সব ইন্দ্রিয় সজাগ বা সপ্রতিভ। ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের কবিতাগুলোয় সব ইন্দ্রিয় শক্তিশালী। পঞ্চইন্দ্রিয় সমভাবেই ফুটে উঠেছে। এটাই জীবনানন্দীয় কবিতার স্টাইল বা মহত্ব। এ কাব্যের কবিতাগুলো পড়ে মনের অজান্তেই গ্রামবাংলার প্রকৃতিরূপ আস্বাদন করা সম্ভব হয়। যেমন বিভিন্ন গাছপালা-লতাগুল্মের নাম চলে এসেছে; তেমনই ফল-মূলের নামও চলে এসেছে বিভিন্ন কবিতার ছত্রে ছত্রে। এসব নামগুলো পাঠককে অন্যরকম অনুভূতি দেয়। বিভিন্ন পাখপাখালির কথাও এসেছে বিভিন্ন কবিতায়। এসব উপাদান নিতান্তই গ্রামবাংলার। লক্ষ্মীপেঁচা থেকে গুবরে পোকা, মাছরাঙা-শঙ্খচিল থেকে বউ কথা কও পাখি কিংবা বেজি-ইঁদুর থেকে মৌমাছি-জোনাকি সবই আছে কবিতার পরতে পরতে।

গ্রামবাংলার এসব উপাদান নিয়ে জীবনানন্দ তার কবিতায় বুনন দিয়েছেন। শিল্পানুভূতি মন থেকেই উৎসারিত। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতাগুলো মনকে নাড়া দেয়, অন্যরকম এক অনুভূতিমালা তৈরি করে। এ সজাগ্রত অনুভূতিমালা মনের সৌন্দর্যের খোরাক দেয়। দেশজ শব্দের ব্যবহার অনেক কবিতায় ফুটে উঠেছে। এমন কিছু কবিতাংশ তুলে ধরছি-

Advertisement

১. একদিন জলসিড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে/... সেইখানে কলমীর দামে বেঁধে প্রেতিনীর মতন কেবল/কাঁদিবে সে সারারাত,- দেখিবে কখন কারা এসে আমকাঠে/সাজায়ে রেখেছে চিতাঃ বাংলার শ্রাবণের বিস্মিত আকাশ/চেয়ে র’বে; ভিজে পেঁচা শান্তস্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে/শোনাবে লক্ষ্মীর গল্প- ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে;/চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি- শাদা শাঁখা- বাংলার ঘাস... (একদিন জলসিড়ি )

২. ‘কোথাও দেখিনি, আহা, এমন বিজন ঘাস প্রান্তরের পারে/নরম বিমর্ষ চোখে চেয়ে আছে- নীল বুকে আছে তাহাদের/গঙ্গা ফড়িঙের নীড়, কাঁচপোকা, প্রজাপতি, শ্যামাপোকা ঢের,/হিজলের ক্লান্ত পাতা,- বটের অজস্র ফল ঝরে বারে-বারে...’ (কোথাও দেখিনি আহা)

৩. ‘...বিনুনি বেঁধেছ তাই-কাঁচাপোকাটিপ তুমি কপালের ’পরে/পড়িয়াছ-তারপর ঘুমায়েছঃ কল্কাপাড় আঁচলটি ঝরে/পানের বাটার ’পরে; নোনার মতো নম্র শরীরটি পাতি/নির্জন পালঙ্কে তুমি ঘুমায়েছ,- বউ কথা কওটির ছানা/নীল জামরুল নীড়ে- জ্যোৎস্নায়- ঘুমায়ে রয়েছে যেন, হায়...’ (অশ্বত্থ বটের পথে)

৪. ‘...যখন চড়াই পাখি কাঁঠালীচাপাঁর নীড়ে ঠোঁট আছে গুঁজে,/যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে খয়েরী পাতায়,/যখন পুকুরে হাঁস সোঁদা জলে শিশিরের গন্ধ শুধু পায়,/শামুক গুগলিগুলো প’ড়ে আছে শ্যাওলার মলিন সবুজে-/তখন আমারে যদি পাও নাকো লালশাক-ছাওয়া মাঠে খুঁজে,/ঠেস্ দিয়ে ব’সে আর থাকি নাকো যদি বুনো চালতার গায়ে,/তাহলে জানিও তুমি আসিয়াছে অন্ধকার মৃত্যুর আহ্বান’। (যদি আমি ঝ’রে যাই)

Advertisement

৫. ‘...মৌরির গন্ধ মাখা ঘাসের শরীরে ক্লান্ত দেহটিরে রেখে/আশ্বিনের ক্ষেতঝরা কচি কচি শ্যামা পোকাদের কাছে ডেকে/র’বো আমি;- চকোরীর সাথে যেন চকোরের মতন মিলনে;/...হলুদ নরম পায়ে খয়েরী শালিখগুলো ডলিছে উঠান;...’ (এখানে ঘুঘুর ডাকে)

৬. ‘এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে সবচেয়ে সুন্দর করুণ:/সেখানে সবুজ ডাঙা ভরে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;/সেখানে গাছের নাম : কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;/সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ;/সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাপসাগরের বুকে,- সেখানে বরুণ/কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল...’ (এই পৃথিবীতে এক)

বিভিন্ন গ্রন্থের কবিতাগুলো থেকে অলংকারের প্রয়োগ ও দেশজ শব্দের ব্যবহার তুলে ধরার চেষ্টা করছি। বন্ধনীর মধ্যে কবিতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে-রাতে-রাতে হেঁটে-হেঁটে (অনুপ্রাসের প্রয়োগ, নির্জন স্বাক্ষর)মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে (সমাসোক্তির প্রয়োগ) মেঠো চাঁদ কাস্তের মতো বাঁকা, পোড়ো জমি (মাঠের গল্প) বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা, ঝিমায়েছে এ পৃথিবী, কার্তিক কি অঘ্রানের রাত্রির দুপুর, মেঠো চাঁদ আর মেঠো তারাদের সাথে জেগেছিল (পেঁচা), চড়ুয়ের ভাঙা বাসা, পাখির ডিমের খোলা, ঠান্ডা-কড়কড়, শসাফুল, মাকড়ের ছেঁড়া জাল, শুকনো মাকড়সা, হিম আকাশের গায় খুদ খেয়ে (পঁচিশ বছর পরে) ভেসে যাবে পাথর বাতাসে, তুমি জল-তুমি ঢেউ—সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন, সাগরের জলের আবেগ, জলের উচ্ছ্বাসে পিছে ধূ ধূ জল তোমারে যে ডাকে, উল্কার আলেয়া শুধু ভাসে, শীতরাতে,—মড়ার হাতের শাদা হাড়ের মতন (পরাবাস্তবতার একটি উদাহরণ) নিশীথের বাতাসের মতো (সহজ), মাটি আর রক্তের কর্কশ স্বাদ, পথের আহত মাছিদের মতো, ঢেউয়ের হুঁচোট লাগে পায়ে,/ঘুম ভেঙে যায় বার-বার/তোমার আমার, ফেনার কাপড়ে বুক ঢেকে, এই হাওয়া যেন হা-হা করে/হু-হু করে ওঠে অন্ধকার (অনুপ্রাসের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়) কত রাত ঝ’রে গেছে, ছেঁড়া দেহে—ব্যথিত মনের ঘায়ে/ঝরিতেছে জলের মতন, বাতাসের সিন্ধু—ঢেউ, নক্ষত্রের আলো পড়ে ঝ’রে, সোনার মতন ধান, ঠাণ্ডা ফেনা ঝিনুকের মতো চুপ আমি, গান গায় সিন্ধু তার জলের উল্লাসে, রূপ যেই স্বপ্ন আনে—স্বপ্নে বুকে জাগায় যে-রস, যেখানে ফেনার গন্ধ নাই, অনেক চলার পথ নক্ষত্রের তলে, চাঁদ জেগে রয়/তারা-ভরা আকাশের তলে/জীবন সবুজ হয়ে ফলে, মাটি ধুলো কাজ করে,—মাঠে-মাঠে ঘাস (কয়েকটি লাইন) গানের সুরের মতো বিকাল, পাখির মতন কেঁপে, হিম চোখ বুজে, নীড়ের মতন বুকে একবার তার মুখ গুঁজে, সমুদ্র ভাঙিয়া যায়—নক্ষত্রের সাথে কথা কয়, উষ্ণ আকাশেরে চায় সে জড়াতে, গোধূলির মেঘে মেঘ, বীণার তারের মতো পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষা, একাকী মেঘের মতো ভেসেছে সে, পাখির মতো স্থির হয়ে, নীল আকাশের আলোর গাঢ়তা, নিশীথের সমুদ্রের মতো চমৎকার, গোধূলির আলো লয়ে দুপুরে সে করিয়াছে খেলা, সূর্যের আলোর পরে নক্ষত্রের মতো আলো জ্বেলে, হাড়ের মতন শাখা ছায়ার মতন পাতা ল’য়ে, ঢেউ ক্ষুধিতের মতো এক সুরে, হতাশ প্রাণের মতো অন্ধকারে ফেলিছে নিশ্বাস, ঝড়ের হাওয়ার চেয়ে আরো শক্তি, এইখানে অশান্ত সাগর তোমারে এনেছে ডেকে, প্রেমিকের হৃদয়ের গানের মতন কেঁপে ওঠে, সন্ধ্যার আলোর মতো পশ্চিম মেঘের বুক ফুটে, সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো ঝড়ের হাওয়ার কোলে জেগে, জোনাকির পথ ধরে, ভোরের মেঘের ঢেউয়ে, আলো-অন্ধকার দিয়ে বুনিতেছি সিন্ধুর বিপ্লবে, তাহার চঞ্চল জল স্তব্ধ হয়ে কাঁপায় হৃদয়, ব্যথিতের স্বপ্নের মতন গোপনের চোখ, মেঘের মতো হঠাৎ চাঁদের বুকে এসে, ফ্যাকাশে মেঘের মতো চাঁদের আকাশ পিছে রেখে, পাখির মায়ের মতো আমাদের নিতেছে সে ডেকে, দেহের ছায়ার মতো আমার মনের সাথে মেশে, গুহার হাওয়ার মতো বন্দী হয়ে মন তব ফেরে, এলোমেলো আধাঁরের মতো হৃদয়, ঢেউয়ের ফেনার মতো ক্লান্ত হয়ে, বিদ্যুতের মতো অল্প আয়ু, ঘুমন্ত বাঘের বুকে বিষের বাণের মতো বিষম ক্ষত, মেঘের চিলের মতো—দুরন্ত চিতার মতো বেগে ছুটে যায় (অনেক আকাশ) পাথরের মতো শাদা গা, পাষাণের মতো হাত, পদ্মা-ভাগীরথী-মেঘনা-কোন নদী সে, নিবু নিবু জ্যোৎস্না, জমানো ফেনার মতো দেখা, হাতির দাঁতের গড়া মূর্তির মতো শুয়ে আছে, ফেনার মতন তারা ঠাণ্ডা-শাদা, ঢেউয়ের মত তারা ঢলে, বরফের কুঁচির মতন মুখ চোখ ভিজে, কাচের গুঁড়ির মতো শিশিরের জল, রূপার মতন চুল ঝিকমিক করে, মেঘের মতন চুল, ধুপের ধোঁয়ার মতো ধলা পুরীর ভেতর, চোখা—ছুরি যেন ধারালো হাতির দাঁত, যৌবন ছিঁড়ে ফেঁড়ে যায়, শরীরের ঘুণ, চোখে ঠোঁটে অসুবিধা—ভিতরে অসুখ, পরী নয়—মানুষও সে হয়নি এখনো, কালো খোঁপা ফেলিত খসায়ে, জটার মতো খোঁপা অন্ধকার (পরস্পর) প্রথম মেয়ের মতো—পৃথিবীর নদী মাঠ বন, যে পাতা হলুদ ছিল-তবুও হলুদ হতে হয়, অঙ্গারের মতো তেজ কাজ (জীবন) সমুদ্র গাহিবে গান বহুদিন, আকাশে আকাশ যাবে জ্বলে, দেহ ঝরে তার আগে ঝরে যায় আমাদের মন, পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই, রাত্রির ঢেউয়ের মতো, আলো অন্ধকারে তোমার পায়ের শব্দ, বালকের মতো এক (১৩৩৩) পৃথিবী এ গহ্বরের মতো ঘুমানো, পাণ্ডুর পাতার মতো শিশির, পায়ের পথের মতো ঘুমন্ত, পুরুষ পাখির মতো,—প্রবল হাওয়ার মতো মৃত্যু, বীণার মতো বেজে ওঠে হৃদয়ের বন, পাখির মতো ব্যথা বুকে লয়ে, বনের শাখার মতো হিম, পাখির শিশুর মতো প্রেমেরে ডেকে ডেকে, আলেয়ার মতো আলো নিয়ে, অঙ্কুরের মতো তুমি, আশার ঠোঁটের মতো, হৃদয়ের গন্ধ বা ধূপের মতো জ্বলে, হাতির হাড়ের মাঠে (সুররিয়ালিজম, প্রেম) মাটির শরীরে তার ছিল যে পিপাসা, রক্ত আর মাংসের স্পর্শসুখভরা, বালকের মতো এক—সমুদ্রের জল, রাঙা রোদ—নারীর মতন, চোখ দুটো ফের ঘুমে ভরে/যেন তার চুমো খেয়ে, এ দেহ—অলস মেয়ে/পুরুষের সোহাগে অবশ, ঝুমকো লতার মতো তার দেহ ফাঁসে, প্রণয়ীর ঠোঁটের ধারালো চুম্বনের মতো, শস্যের মতো শরীর ছিঁড়ে আহত, আগুনের মতো দুপুরের রাঙা রোদ, লাল আলো—রৌদ্রের চুমুক/অন্ধকার,—কুয়াশার ছুরি, হেমন্তের রৌদ্রের মতো ফসলের স্তন, কীটদের মতো আহত, লতার মতো চুল (পিপাসার গান) আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর, ডানার ঘ্রাণ চারিদিকে ভাসে, রবারের বলের মতো ছোট বুকের জীবন, খেলার বলের মতো তাদের হৃদয় (পাখিরা) পুরানো পেঁচার ঘ্রাণ, নম্র নীল জ্যোৎস্নার ভিতর, সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্ক্ষা, হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা, নির্জন মাছের চোখে, মিনারের মতো মেঘ, বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম যেন শক্ত হয়ে আসে, বাতাসে ঝিঝিঁর গন্ধ, রাঙা কামনার শিয়র, ধূসর মৃত্যুর মুখ (মৃত্যুর আগে) নিরালা ঢেউয়ের পাশে, গোধূলির অস্পষ্ট আকাশে, সন্ধ্যা নদীর জল—পাথরের জলের ধারা/আয়নার মতো, আলো আর অন্ধকারে গিয়াছে মুছিয়া, হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার নদী (স্বপ্নের হাতে) ইত্যাদি কবিতায় এসব লোকজ উপাদান ও অলংকার ব্যবহার করা হয়েছে।

কবি জীবনানন্দ দাশ উপমা ব্যবহারে দারুণ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। বিভিন্ন ঋতুর বর্ণনায় বর্ণিল হয়েছে কবিতাগুলো। ভাষা দিয়ে, উপমা সাজিয়ে বা ছন্দ মিশিয়ে জীবন্ত হয়েছে কবিতাগুলো। ‘উপমাই কবিত্ব’ কবির এ উপলব্ধি এসব কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। খইয়ের ধানের মতো আমি দেখিয়াছি ঝরে ঝর ঝর, অস্ফুট করুণ শব্দ ডুবিতেছে অন্ধকারে নদীর ভিতর, গুবরে পোকার তুচ্ছ বুক থেকে ক্ষীণ, কাকের তরুণ ডিম পিছলায়ে প’ড়ে যায় শ্যাওড়ার ঝাড়ে (পৃথিবীর পথে আমি) দুপুরের নিঃসঙ্গ বাতাসে, ঝিলমিল ডানা নিয়ে উড়ে যায় আকাশের থেকে দূর আকাশের পিছু, প্রসন্ন প্রাণের স্রোত (বাতাসে ধানের শব্দ) ঝিঁঝিঁর সবুজ মাংস, আকন্দবনের ভিড়, মাকাল লতার তল, শিশিরের নীল জল, ন্যাড়া অশ্বত্থ (ভেবে ভেবে ব্যথা পাবো) টসটসে ভিজে জামরুল, নরম জামের মতো চুল, ঘুঘুর বুকের মতো অস্ফুট আঙুল (এই সব ভালো লাগে) কামরাঙা-লাল মেঘ যেন মৃত মুনিয়ার মতো, বাংলার নীল সন্ধ্যা- কেশবতী কন্যা যেন এসেছে (আকাশে সাতটি তারা)আকাশে ‘নরম ধানের গন্ধ’- কলমীর ঘ্রাণ, হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা সরপুটিদের, মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর চাল ধোয়া ভিজে হাত (আকাশে সাতটি তারা) অপরাজিতার মতো নীল হ’য়ে, কল্কা পেড়ে শাড়ি, গাঢ় বিষণ্নতা (যতদিন বেঁচে আছি) কল্কা পেড়ে শাড়ি (যতদিন বেঁচে আছি) ইত্যাদি তা প্রমাণ করে। অঘ্রান-কার্তিক কবির প্রিয় সময়। বিভিন্ন উপকরণে প্রকৃতি ধরা দিয়েছে বিভিন্ন রূপে। চিল-হরিণ-জোনাকি-বেড়াল-বাদুড়, চাঁদ-নক্ষত্র-আকাশ-সাগর-নদী, ডানা-লতা-ঠাং-শরীর-পালক, ঘ্রাণ-ঘুম-নির্জনতা, হিজল-ঝাউবন, লেবু-আমলকি-দেবদারু, পাতা-ঘাস-ধান, বালি-শিশির-হাওয়া-রোদ-জ্যোৎস্না, ঝড় ঢেউ, নীল-সবুজ হলুদ, মুখোমুখি-স্তব্ধতা-অন্ধকার-নগ্ন-শাঁই শাঁই শব্দ, রূপালি ইত্যাদি ধরা দিয়েছে জীবনানন্দের কবিতায়। এসব শব্দাবলী ও এরকমই একার্থক শব্দাবলীর বারবার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এগুলো প্রতীকী হিসাবেও ধরে নেওয়া যায়। নগ্ন, অন্ধকার যেমন হতাশার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে; তেমনই হিজল-ঝাউবন প্রকৃতি বা সৌন্দর্যের প্রতিনিধি। আবার স্ফটিক, নীল আকাশ ইত্যাদি জীবন-মনের উদারতা ও ঔজ্জ্বল্য প্রকাশিত হয়েছে।

ইংরেজি সাহিত্যের চিত্রকল্পের সেরা কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও জন কিটস; তেমনই বাংলা সাহিত্যে চিত্রকল্প নির্মাণের সেরা কবি জীবনানন্দ দাশকেই বলা যায়। এক্ষেত্রে তিনি দেশজ বা গ্রামীণ উপাদান ব্যবহার করেছেন। গ্রামীণ উপাদান ব্যবহার করলেও সময়ে আটকে পড়েননি, সার্বজনীন হয়েছেন। সময়োত্তীর্ণ হয়েছেন; বাঙালির হৃদয়ে পৌঁছে গেছেন। সব মিলিয়ে অলংকারিক ভারসাম্য বজায় রাখার কৃতিত্ব কবি জীবনানন্দকে দেওয়াই যেতে পারে। তাকে কৃতিত্ব না দিলে তাঁর প্রতি অবিচারই করা হবে।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।

এসইউ/জিকেএস