সাহিত্য

ফিরবো না তোমার বসন্তে

সানজিদা সামরিন

Advertisement

শীতলদার সঙ্গে যেদিন প্রথম আলাপ হয়; সেদিন ছিল বসন্তের প্রথম দিন। তার সঙ্গে আমার পরিচয় উষাদির এনগেজমেন্টে মণীষাদের বাড়ি। মণীষা আমার বন্ধু। অনুষ্ঠানে শীতলদা এসেছিলেন তার পিসির বাড়ি। উষা-মণীষা শীতলদার পিসতুতো বোন। বিকেলবেলা মাসিমা, আমি আর মণীষা রান্নাঘরে কাজ করছিলাম। দুই পর্দার মাঝ দিয়ে সোনালি পেড়ে সাদা ধুতি আর নীল পাঞ্জাবি পরে শীতলদা ঢুকলেন।

দৃশ্যটি আমি আজও চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাই। আমি জানতে চাইনি তরুণ রবীন্দ্রনাথের মতো দেখতে ছেলেটি কে? সে সময় আমি কিছুই জানতে চাইতাম না। প্রশ্ন আমার মনে এসেই ইস্তফা দিতো, মুখ অবধি গড়াতো না। এরপর ফাগুন থাকতে থাকতেই ফাঁকা সময়ের সঙ্গী আর দুঃসময়ের অবলম্বন দু’টোই হয়ে গেলেন শীতলদা। অবলম্বন শব্দটা হয়তো একটু বেশিই গাঢ় হয়ে গেল। এসব বলতে নেই, মনেই থাকা ভালো। সহজ কথা এ দুনিয়ায় বড্ড কঠিন। শীতলদা এমন একজন যাকে আশ্রয় করা যায়। মন গলিয়ে বহুক্ষণ কথা বলা যায়। মানুষটাই এমন, যাকে ঘর মনে হয়।

বহুদিন পর শীতলদার চিঠি পেলাম। একটা চিঠি কেবল দুটো শব্দেই শেষ হয়ে গেল? ‘শুধু কেমন আছো?’ বলেই শেষ? অথচ দিনের ভেতর কতবার চিঠির ভাঁজ খুলে যে ওই দুটো শব্দই পড়ি, তার হিসেব নেই। আমার মস্তিষ্কের এক কোণে চুপটি করে বসে আছেন তিনি। তার গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস প্রতিনিয়ত উজ্জীবিত করে আমায়। এটা হয়তো পুরোটাই নিজের মস্তিষ্ককে দেওয়া আমারই বিশ্বাস। ভ্রান্ত? কী জানি! শীতলদা একটা পজিটিভ এনার্জি হয়ে রয়েছেন আমার জন্য।

Advertisement

কিছু মানুষ ভয়ানক ঐশ্বরিক ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে আসেন, থেকে যান স্পর্শের বাইরে। কিন্তু হৃদয় ছুঁয়ে থাকেন সর্বক্ষণ। নাহ, হচ্ছে না। রোজ রোজই চিঠির উত্তর লিখবো বলে বসি। কিন্তু নিজের জন্যই লেখা হয়ে যায়, তার জন্য নয়। কী বলবো তাকে আমি? কী দেবো পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট চিঠির উত্তর? অনেক কিছু বলার থাকলেই বুঝি আর বলা হয়ে ওঠে না।

আমার জীবনের প্রবেশদ্বার দিয়ে যেদিন শীতলদা প্রবেশ করলেন; ঠিক তখন থেকেই বারবার কেবল তাকে হারিয়েই গেছি। কিন্তু যেটুকু পেয়েছি তার মূল্য বুঝে নিতে নিতেই এক অদ্ভুত ভালো লাগা এক অদ্ভুত অনুভূতি আমাকে জর্জরিত করে ফেলে। অত ভালো লাগা আমি সইতে পারি না। একা থাকার প্রয়োজন পড়ে বড়।

প্রথম দেখার পর একটু বুঝতে না বুঝতেই শীতলদা চলে গেলেন কলকাতা। এরপর ঈশ্বরের বরে তার ছোট ভাইয়ের সঙ্গেই বিয়ে হলো আমার। কিন্তু বিয়েতে তিনি নিজেই উপস্থিত ছিলেন না শত ব্যবস্তার বাহানায়। এখন তো শিলিগুড়ি থেকে আসেন না বললেই চলে। শীতলদা ব্যস্ত, শীতলদার অসুখ, শীতলদার এটা-ওটা বুঝতে বুঝতে বড্ড বুঝে গেছি যে, তিনি এড়িয়েই যেতে চান সব কিছুকে।

গেলবার শরতে যখন তিনি বাড়ি এলেন। তখন সেটাই বিয়ের পর তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। তার দিকে তাকাতেই বুকের ভেতর বজ্রপাত হয়েছিল যেন। বিস্মিত হবো, না আনন্দিত হবো ঠাহর পাইনি। বারবারের মতোই তার চাহনি যেন আমার মুখের প্রতিটি কোষ সূক্ষ্মভাবে রপ্ত করে নিয়েছিল। তখনো নিজেকে লুকোতে ব্যর্থ হয়েছিলাম আমি। এতটুকু ঈর্ষা নেই তার। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে হীরের মতো জ্বলজ্বলে দুটো চোখে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। বলেছিলাম, ‘আমাকে আগের মতো আর মনে পড়ে না তাই না? যেচে পড়ে ভুলে গেছেন?’তিনি তখন শান্তস্বরে বললেন, ‘কেন মনে হলো?’উত্তরে বলেছিলাম, ‘উপলব্ধি হয়।’শীতলদা চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বললেন, ‘উপলব্ধিতেই আছ।’

Advertisement

তার শীতল-শান্ত কণ্ঠের এ দুটি শব্দ আমার চুলের গোঁড়া থেকে পায়ের আঙুল অবধি অসাড় করে ফেলেছিল। এতটাই অসাড় হয়ে আসছিল যে, আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভবপর হয়নি আমার। তড়তড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে নিজের ঘরে বসে কেঁদেছি। মেয়েরা খুবই অদ্ভুত, বিরক্তিকর তাই না? কারণে-অকারণে, সুখে কান্না পেয়ে যায়। যার কোনো ব্যাখ্যা নেই। এসব ব্যাখ্যা চাইতে চাইতে ক্ষান্ত হয়ে আমার বর শ্রাবণ সন্ধ্যা নামালো।

অবশ্য ওর আর আমার সন্ধিই হয়নি কখনো। সেটুকু সময়ও তার হাতে ছিল না আমার জন্য। শীতলদার ছোট ভাই হওয়ায় আমার বাবার কাছে শ্রাবণের মতো সুপাত্র আমার জন্য ছিল না বৈকি! ভালো ও ভদ্র পরিবারের সুদর্শন ছেলে। ক্যারিয়ার নিয়ে ভীষণ অ্যাম্বিশাস। কিন্তু বিয়ের পর প্রতিটি দিনই মনে হয়েছে শ্রাবণ অনেক খ্যাতি পাবে কিন্তু আমি একা হতে হতে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছি। শ্বাস নিতে পারছি না। বাবার বিশাল লাইব্রেরির এককোণে চুপটি করে বসে আফ্রিকান লোককাহিনি অনুবাদ করে যাওয়া বীভাবরীকেই খুঁজেছি দিনের পর দিন।

যা-ই হোক, তার দু’দিন পরই শীতলদা ফিরে গেলেন তার কাজের জায়গায়। এরপর দীর্ঘদিন কোনো যোগাযোগ হয়নি। কিছুদিন আগে মণীষা এলো শিলিগুড়ি থেকে। শ্রাবণের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর আপাতত বাবার বাড়িতেই আছি। লাইব্রেরির যে দায়িত্ব শীতলদা পালন করতেন দু’বছর আগে, সে চেয়ারেই বসছি। মণীষা নিজে এসে শীতলদার পাঠানো একবাক্স বই দিয়ে গেল আমার হাতে। এ-ও বলে গেল, ‘বাক্সটা যেন আমিই খুলি।’

বাক্স খুলেই ভাঁজ করা ছোট্ট চিরকুট দেখে সেই দু’বছর আগের মতোই প্রাণভ্রমরা মনে হলো গোলাপি ছোট্ট কাগজটাকে। ভাঁজ খুলতেই পেলাম দুটো শব্দ, ‘কেমন আছ?’ যে দুটো শব্দের উত্তর রোজ রোজ লিখেই যাচ্ছি, যেন শেষই হচ্ছে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, শুরুই তো হলো না বলা। আবার কখনো মনে হয়, এবার আর শীতলদাকে যেতে দেব না। কলকাতা বা শিলিগুড়ি বা প্যারিস বা অন্য কোথাও।

কোনো এক বসন্তে তার মতো আমিও হুট করে পরিচিত পায়ের শব্দ, শিউরে ওঠার মতো গন্ধ, বারান্দায় রকিং চেয়ারে বেলফুল ফেলে চলে যাবো দূরে কোথাও। ফিরবো না, কোনো চিঠিই আর দেবো না। শুধু মনে মনে একবার বলবো, ‘তোমার মঙ্গল হোক’।

এসইউ/এএসএম