অর্থনীতি

কৃষি ও এসএমই অর্থনীতির বড় শক্তি : আসাদুজ্জামান

আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক খাতের তদারকিতে এর সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে বির্তক হতে পারে। তবে গত ৫ বছরে বেশ কিছু আর্থিক সূচকে সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কৃষি খাত, এসএমই খাত, আর্থিক অন্তর্ভূক্তিমূলক কার্যক্রমসহ অনেক ক্ষেত্রে বড় সাফল্য পেয়েছে। জাগোনিউজের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলেছেন সহকারি মুখপাত্র ও মহাব্যবস্থাপক এএফএম আসাদুজ্জামান। দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি কাজ করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকে। সম্প্রতি তার সঙ্গে কথা বলেছেন আমাদের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সাইদ আরমান। ছবি তুলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা আরিফ হাসান।জাগোনিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষি খাতকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছে। এ খাত নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাই।  আসাদুজ্জামান: দেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব বিবেচনা এবং এ খাতের উন্নয়নে সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবছর কৃষি ঋণ নীতিমালা প্রণয়নসহ কৃষকবান্ধব নানা উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে সমাজের কৃষক, বর্গাচাষি, খুদে ও নারী উদ্যোক্তা, পরিবেশবান্ধব অর্থায়নের মতো উৎপাদনশীল খাতগুলোতে অর্থায়ন বাড়ানোসহ আর্থিক সেবার বাইরে থাকা জনসাধারণকে আর্থিক সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে দেশব্যাপী ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন বা আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। কয়েক বছর আগেও বিদেশি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত কৃষিতে একটি টাকাও ঋণ দিত না। কিন্তু এখন চিত্র পাল্টে গেছে। সব ব্যাংককেই এখন কৃষি খাতে ঋণ দিতে হয়, আমাদের কৃষক ভাই-বোনদের পাশে দাঁড়াতে হয়। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল ৯ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা, সেখানে গত অর্থবছরে কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে রেকর্ড ১৬ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে এ খাতে প্রবৃদ্ধি প্রায় ৭৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ১৫ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। জাগোনিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময় বর্গাচাষিদের ঋণ নিশ্চিত করতে কথা বলে। আপনি কি মনে করেন?আসাদুজ্জামান: আগে বর্গাচাষিরা ব্যাংক ঋণ পেতো না। এ উপেক্ষিত বর্গাচাষিদের দোরগোড়ায় সহজ শর্তে কৃষি ঋণ পৌঁছে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৯ সালে একটি বৃহৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৫০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করে। এটি একটি সফল উদ্যোগ হিসেবে সর্বমহলে সমাদৃত হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় গত পাঁচ বছরে ৮ লাখ ৬৩ হাজার বর্গাচাষিকে ১ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা অর্থায়ন করা হয়েছে। গত চার অর্থবছরে আমদানি নির্ভর ফসল চাষে ব্যাংকগুলো কৃষক পর্যায়ে ৩০৯ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। জাগোনিউজ: অর্থনীতির অন্যতম শক্তি ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত-এসএমই। এসএমই`তে কতটা সাফল্য পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকাণ্ড।আসাদুজ্জামান: নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক এসএমই খাতে অর্থায়নের উপর জোর দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, কৃষি ও এসএমই বাদে অর্থনীতির বড় চালিকা শক্তি। গত চার বছরে (২০১০-২০১৩) ব্যাংকগুলো ১৮ দশমিক ৩৫ লাখ এসএমই উদ্যোক্তাকে ২ লাখ ৬২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা এসএমই ঋণ বিতরণ করেছে। ৯০ হাজার নারী উদ্যোক্তাকে ঋণ দেয়া হয়েছে ৯ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে এসএমই ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৮ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। বছরের প্রথম ছয় মাসে বিতরণ করা হয়েছে ৪৭ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৫৩ শতাংশ। জাগোনিউজ: এসএমই খাতের পুনঃঅর্থায়ন নিয়ে যদি বলেন।আসাদুজ্জামান: এসএমই খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল, আইডিএ, এডিবি ও জাইকার অর্থায়নে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশ কয়েকটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল চালু করা হয়েছে। এসব তহবিলের আওতায় এ পর্যন্ত ২৫টি ব্যাংক ও ২১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে মোট ৪১ হাজার ৯৫২টি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রায় ৩ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি ডিসিসিআই’র সহায়তায় নতুন উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে ১০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠন করা হয়েছে। এসএমই খাতের পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের ১৫ শতাংশ অর্থ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণদানে ব্যাংকগুলো অনেক বেশি মনোযোগী হয়েছে। গত চার বছরে ৯ হাজার ৬১২ জন নারী উদ্যোক্তা ৭৫৪ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা পেয়েছে।জাগোনিউজ: নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে আপনারা কতটা ভূমিকা রাখতে পেরেছেন?আসাদুজ্জামান: এসএমই খাত উন্নয়ন প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ব্যাংক সবসময়ই নতুন নতুন উদ্যোক্তাকে ব্যাংক অর্থায়নের আওতায় নিয়ে আসার বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে আসছে। সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী উদ্যোগে নতুন উদ্যোক্তাদের অর্থায়নে উৎসাহ প্রদান করা হয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিগত ৫ বছরের প্রচেষ্টায় দেশে ২ লাখ ৫০ হাজার নতুন উদ্যোক্তাকে ৪৯ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে। ২০১৪ প্রথম ৬ মাসে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ৩৮ হাজার ২৫৩ জন উদ্যোক্তাকে ৭ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে।জাগোনিউজ: ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনের আওতায় নতুন ব্যাংক হিসাবের সর্বশেষ চিত্র নিয়ে বলবেন কী। আসাদুজ্জামান: আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অংশ হিসেবে গরীব কৃষকদের দশ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ করে দেয়া হয়। এখন বাংলাদেশের কৃষকদের প্রায় ৯৭ লাখ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। কৃষকদের সরকার যে ভর্তুকি দেয়, ব্যাংকগুলো কৃষকদের যে ঋণ দেয়, সেটা যায় এসব অ্যাকাউন্টে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুফল ভোগ করছে যেসব হতদরিদ্র মানুষ, তাদেরও রয়েছে এরূপ ৩৬ লাখের বেশি অ্যাকাউন্ট। অসহায় মুক্তিযোদ্ধারা এখন ভাতা পাচ্ছেন তাদের নামে খোলা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। কৃষক ও হতদরিদ্রদের এসব হিসাব সচল রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব উৎস থেকে ২০০ কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন রয়েছে। এসব হিসাবধারী এ তহবিল থেকে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ পাচ্ছে। ‘স্কুল ব্যাংকিং’ এর আওতায়গত চার বছরে ৫৬টি ব্যাংকে ৬ লাখ ৪০ হাজার স্কুল ছাত্র-ছাত্রী ব্যাংক হিসাব খুলেছে। এসব হিসাবে জমার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০৭ কোটি টাকা।জাগোনিউজ: দেশের মোবাইল ব্যাংক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ে কিছু জানতে চাই। আসাদুজ্জামান: কম খরচে দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে টাকা পাঠানোর প্রযুক্তি নির্ভর সহজ সেবা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালের প্রথম দিকে ব্যাংকের নেতৃত্বাধীন মোবাইল ব্যাংকিং চালু করে। ইতোমধ্যে ২৮টি ব্যাংককে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রদানের অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে ১৯টি ব্যাংক এ সেবা চালু করেছে। মোবাইল ব্যাংকিং সেবাকে মজবুত ভিত্তি দেয়ার লক্ষ্যে ২২ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে এ সম্পর্কিত একটি বিস্তারিত গাইডলাইন জারি করে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নীতি নির্ধারণে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অতি সম্প্রতি এলায়েন্স ফর ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন পলিসি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাহকের সংখ্যা এখন ২ কোটি ৭ লাখ। ব্যাংকগুলো ৪ লক্ষ ৭৭ হাজার এজেন্টের মাধ্যমে এ সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় গড়ে প্রতিদিন ৩৩৩ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। জাগোনিউজ: বর্তমান গভর্নরের মেয়াদকালে সামাজিক দায়বদ্ধতা একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। আপনি সিএসআর নিয়ে কাজ করেছেন। একটু বিস্তারিত যদি বলতেন।আসাদুজ্জামান: ২০০৯ সাল থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমের মূলধারায় সিএসআর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ হাতে নেয়। গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতে সিএসআর ব্যয় ৫৫ কোটি টাকা থেকে প্রায় আটগুণ বেড়ে ৪৪৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গড়ে সিএসআর ব্যয় হয়েছে ২৫২ কোটি টাকা। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় চর, হাওড় ও প্রান্তের শীতাক্রান্ত মানুষদের মাঝে ব্যাংকগুলো ব্যাপকহারে শীতবস্ত্র বিতরণের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। রানা প্লাজা ধসে আহত ও নিহতদের সাহায্যার্থে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ১০০ কোটি টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অনুদান দেয়। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় উদ্ধার অভিযানে অংশগ্রহণকারী ১৩৫ জন বীর স্বেচ্ছাসেবককে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে সম্মানসূচক সনদপত্র এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকে প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা সম্মাননা প্রদান করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজেও বাংলাদেশ ব্যাংক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান হলেও প্রতি বছর কিছু পরিচালন মুনাফা করে। এ মুনাফা থেকে সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে দুর্যোগ মোকাবেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অগ্রাধিকারমূলক সিএসআর কর্মকাণ্ড অর্থ সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল’ নামে একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। এই তহবিলে প্রতি বছর ৫ কোটি টাকা প্রদান করা হচ্ছে। গত অর্থবছরে এ তহবিল থেকে ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে ৫ কোটি টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে। জাগোনিউজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।আসাদুজ্জামান: জাগোনিউজকেও ধন্যবাদ।

Advertisement