মুক্তিযুদ্ধের শেষ ১৪ দিনেই এ দেশে হত্যা করা হয় ১১৬ জন বুদ্ধিজীবীকে। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাতে পাকিস্তানি হানাদার ও এদেশীয় দোসরদের হাতে শহীদ হন আরো অনেক বুদ্ধিজীবী। এই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নেতৃত্বে ছিলো সে সময়ে ইসলামি ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। এখনকার জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল। রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করে চারদলীয় জোট সরকার যার হাতে তুলে দিয়েছিলো বাংলাদেশের পতাকা। ২০০৮ সালে বেশ দম্ভ নিয়েই বলেছিলেন, এদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। তার বিরুদ্ধে ওঠা একাত্তরের সব অপরাধের অভিযোগও অস্বীকার করেছিলেন অবলীলায়।এবার বলি আরেকজনের কথা। দম্ভোক্তি আর উদ্ভট মন্তব্য যার শিরায় শিরায়। ট্রাইব্যুনালে উদ্ভট মন্তব্য এবং কেওয়াজ সৃষ্টি করে বারবার এসেছেন আলোচনায়। প্রতিপক্ষতো বটে, নিজের আইনজীবীকে নিয়েও বিরূপ মন্তব্য করতে ছাড়েননি। সেটাই স্বাভাবিক তার কাছে। কারণ নিজ দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে নিয়ে তার করা `কুকুর ও লেজ তত্ব` বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত-আলোড়িত ভীষণভাবে। বলছি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কথা। সাকা চৌধুরী নামেই বেশি পরিচিত। একইভাবে পরিচিত তার অট্টহাসি।এই দুইজনই আজ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সর্বভাবে প্রমাণিত। ফাঁসির দড়িতে ঝোলা থেকে আর মাত্র এক ধাপ দূরে (রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা)। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রাম অঞ্চলের নৃশংসতম মানবতাবিরোধী অপরাধের হোতা ছিলেন সাকা চৌধুরী। অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যাসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে চারটি হত্যা-গণহত্যার দায়ে তার ফাঁসির আদেশ বহাল থাকলো আপিল বিভাগের চূড়ান্ত আদেশেও। বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে একই পরিণতি বদর কমান্ডার মুজাহিদের।এই দেশ আর দেশের মানুষকে নিয়ে কতটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যায় তার বড় ধরনের নজির সাকা। মুজাহিদও কম যায়নি। নিজেকে তারা এতটাই ক্ষমতাধর ভাবতো যে, কেউ তাদের কখনো ছুঁতে পারবে- তা যেন কল্পনাই করতে পারেনি। চার দশকে সাধারণ থেকে অসাধারণ পর্যায়ের অনেক মানুষই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন- এদের বোধ হয় আর বিচার হবেই না। কিন্তু স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিগুলো। তাইতো পরাজয় হলো সব অবিশ্বাসের। পরাজিত হলো দেশি-বিদেশি লবিস্ট চক্র। প্রমাণ হলো দাম্ভিকতার পতন অনিবার্য।ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচতে কোনো চেষ্টাই বাদ রাখেনি যুদ্ধাপরাধীরা। একজনকেতো চাঁদে দেখিয়ে রীতিমতো তাণ্ডব চালানো হলো সারাদেশে। জামায়াত-শিবিরের পেশিশক্তিতে মরলো অসংখ্য মানুষ। জাতভাই পাকিস্তান সরকারের তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো। এই চক্রের টাকার শক্তিটাও নেহায়েত কম নয়। ডেভিড বার্গম্যানের মতো ভাড়াটে সাংবাদিক আর আল-জাজিরাকে দিয়ে একপেশে সংবাদ পরিবেশন- কোনোটিই বাদ রাখেনি তারা। একাত্তরের সব মানবতাবিরোধী অপরাধের কথা ভুলে গিয়ে পশ্চিমা মানবতার ধ্বজাধারী হিউম্যান রাইটস ওয়াচ শুরু থেকেই কথা বলে যাচ্ছে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে। সবশেষ- অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ধৃষ্টতা। কোনোকিছুতেই থামানো গেলো না ন্যায়বিচার।লেখার প্রথমভাগেই বলেছিলাম সাকা চৌধুরীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আর হাস্যকর কাজকর্ম ও কথাবার্তার বিষয়টি। ৪৪ বছর ধরে যে মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন এই যুদ্ধাপরাধী, বিচারের শেষদিন পর্যন্ত তার সেই মিথ্যার বেসাতিই দেখলো জাতি। রায় পুনর্বিবেচনার শুনানিতে আপিল বিভাগে সবশেষ চেষ্টা হিসেবে আরেকটি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। মিথ্যা না বলে জালিয়াতি বলাই ভালো। জমা দিয়েছেন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভুয়া সনদ। যেখানে তার সেশন দেখানো হয়েছে ১৯৭১ সাল। অথচ পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. লিয়াকত আলীর সই করা একটি চিঠিতে সাকা`র সেশন দেখানো হয়েছে ১৯৭০-৭১। নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবর্ষ পরেরটির মতোই হওয়ার কথা। তাহলে সার্টিফিকেটে কেন ভুল পদ্ধতিতে শিক্ষাবর্ষ লেখা? বিশ্ববিদ্যালয় এক, কিন্তু দুইটি কাগজে বানান আলাদা। সার্টিফিকেটে লেখা The University of The Panjab। অন্যদিকে, রেজিস্ট্রারের চিঠিতে University of The Punjab। বলা হয়েছে, সাকা চৌধুরী ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এরপর ক্রেডিট ট্রান্সফার করে চলে যান পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ একই সময়ে একই বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন আজকের অ্যাটর্নি জেনারেল। আদালতকে তিনি জানিয়েছেন, ক্রেডিট ট্রান্সফার করা যায় কেবল সেমিস্টার পদ্ধতিতে। কিন্তু তাদের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পদ্ধতিই ছিলো না। তাই সুযোগ ছিলো না ক্রেডিট ট্রান্সফারেরও। অর্থাৎ পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সনদপত্র এবং রেজিস্ট্রারের চিঠি দেয়া হয়েছে, তাকে নিশ্চিতভাবেই ভুয়া মনে করেছে আপিল বিভাগ। রিভিউ আবেদনের শুনানিতে প্রধান বিচারপতিও বলেছেন, একটি মিথ্যাকে ঢাকতে শত মিথ্যা কথা বলা হয়েছে।আসলে শত মিথ্যা নয়। গেলো ৪৪ বছরে হাজার হাজার মিথ্যা বলে গেছে এই যুদ্ধাপরাধীরা। তৈরি করেছিলো মিথ্যা ইতিহাস। শিখিয়েছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধের মিথ্যায় মেশানো খণ্ডিত অংশ। কিন্তু এত রক্তের বিনিময়ে যে দেশের জন্ম, সেখানেতো মিথ্যার জয় হতে পারে না। তাহলে যে বদলে যায় পৃথিবীর ইতিহাস। থমকে যায় মানবতা। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির চক্রান্তে হত্যা করা হয় জাতির জনককে। সেদিনও বোধ হয় এতটা কষ্ট পায়নি বাংলাদেশ, যতটা পেয়েছিলো এই দুই যুদ্ধাপরাধীর হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওঠার পর। তাদের যুদ্ধাপরাধে যতটা না কালি লেগেছে মানব ইতিহাসে, তারচেয়ে ঢের বেশি কলঙ্ক হয়েছে তাদের গাড়িতে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে। শিশির ভট্টাচার্যের সেই কার্টুন বাংলাদেশের বেদনার, কষ্টের ছবি হয়ে থাকবে আজীবন। তবে সেই কষ্ট থেকে মুক্তির সময় এসেছে আজ। সময় এসেছে দায় মোচনের। কতটা কষ্ট, কতটা হতাশা থেকে একাত্তরের শহীদদের জিজ্ঞেস করেছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী! `তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?` এর উত্তর কবি নিজেই দিতে পারবেন। হয়তো দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক হানাহানি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ষড়যন্ত্র, বিচারহীনতা- সবকিছু মিলিয়েই কবির এই প্রশ্ন। কিন্তু আগেই বলেছি, প্রতিশোধের ইচ্ছে নয়, সত্যজয়ের আশাতেই বেঁচে ছিলো বাঙালির স্বপ্ন। বিচার তাই হচ্ছে, বিচার তাই হবে। তাইতো আজ আনন্দের অশ্রু চোখে নিয়ে ভীষণ গর্ব করে শহীদদের বলতে পারি, `তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে আজ তা বাংলাদেশ।`৪৪ বছর ধরেই এমন রায়ের অপেক্ষায় গোটা বাংলাদেশ। ৪৪ বছর ধরেই বিচারের প্রত্যাশায় ছিলো একাত্তরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মা। ৪৪ বছর ধরেই আমরা গেয়ে গেছি সব ক`টা জানালা খুলে দেয়ার গান। ৪৪ বছর ধরেই আমরা আশায় আছি ওরা আসবে। অবসান হয়েছে সেই প্রতীক্ষার। খুলে গেছে সব ক`টা জানালা। ওরা ছিলো আমাদের আত্মার মাঝেই। ওরা ঠিকই ফিরে এসেছে এই স্বাধীন বাংলাদেশে। এখন কেবল সেই শহীদদের প্রতীক্ষা- আমাদেরও প্রতীক্ষা- দ্রুত কার্যকর হোক রায়। ফাঁসির দড়িতে ঝুলুক যুদ্ধাপরাধীরা। মুছে যাক ইতিহাসের দায়।লেখক : বার্তা সম্পাদক, এসএটিভিshahariar@journalist.comএইচআর/আরআইপি
Advertisement