প্রতিবন্ধীদের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে আইন রয়েছে। শিক্ষানীতিতেও সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আছে। এরপরও খোদ রাজধানীতেই মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় সকল সুবিধা বঞ্চিত প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) পরিচালিত এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। একই সঙ্গে সুবিধা বঞ্চিত হওয়ার কারণ ও সুবিধা নিশ্চিত করায় করণীয় বিষয়ে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।মাউশি সূত্র জানায়, মাধ্যমিক স্তরে অটিজম ও স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের সারাদেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় একীভূতকরণের বাস্তবতা পর্যালোচনায় একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। অটিস্টিক একাডেমি স্থাপন প্রকল্প নভেম্বর মাসের শুরুতে রাজধানীর নামকরা ৮৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জরিপ করে।এরমধ্যে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ সরকারি ও ৮৮ দশমিক ৫ শতাংশ বেসরকারি বিদ্যালয়। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের ৫০ জন সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকরা এই জরিপ করেন। এতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সুবিধা বঞ্চিত হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও অটিজমবিষয়ক জাতীয় অ্যাডভাইজার কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত একীভূত শিক্ষা বলতে অটিজম শিশুদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একত্রীকরণকে বুঝায় মন্তব্য করে জাগো নিউজকে বলেন, অটিজম শিশুরা শিক্ষার দিক দিয়ে একটু পিছিয়ে থাকে। অটিজম শিশুদের শুরু থেকে যদি স্বাভাবিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একত্রীকরণ করা হয় তাহলে স্বাভাবিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে তারাতারি ভাষা শিখে। তাদের ব্যবহারে যে অস্বাভাবিকতা থাকে স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে মিশলে কিছুটা সংশোধন বা পরিবর্তন হয়। অটিজম শিশুদের যে দৃষ্টিভঙ্গির নির্ণায়ক তারা একীভূত শিক্ষাতে যুক্ত হলে স্যোসালিজম ও ইন্টিগ্রিয়েশন হয়। এই বিষয়গুলো চিন্তা করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অটিজম শিশুদের জন্য একীভূত শিক্ষা সুবিধা নিশ্চিত করা উচিত এবং সব জায়গাতেই করা উচিত বলে মনে করেণ তিনি।জরিপ প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপকরণ আছে মাত্র ৯ দশমিক ২ শতাংশ বিদ্যালয়ে। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের চলাচলের জন্য র্যাম্প আছে মাত্র ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ বিদ্যালয়ে। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রবেশগম্যতা উপযোগী টয়লেট আছে ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ। শ্রেণিকক্ষে প্রবেশগম্যতা উপযোগী ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ। কাউন্সিলিং সহায়তা আছে ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থী নেই ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ বিদ্যালয়ে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থী আছে ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ১ দশমিক ১ শতাংশ। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ৩ দশমিক ৪ শতাংশ।জরিপে অটিজম ও স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। সরকারি বিদ্যালয়ে গড়ে ২১ জন ও বেসরকারি বিদ্যালয়ে ১জন ভর্তি আছে। গড়ে প্রতি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী আছে ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। প্রতিবন্ধী শিশুদের ভর্তি করাতে ইচ্ছুক ৫৬ দশমিক ৩ শতাংশ বিদ্যালয়। ভর্তি করাতে অনিচ্ছুক ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ বিদ্যালয়। আইইপি ২ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রতিবন্ধী শিশুদের পাঠদানে ৬৭ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষকের প্রশিক্ষণ নেই বলে জরিপে প্রকাশ করা হয়েছে।জরিপে মাধ্যমিক স্তরে অটিজম ও স্নায়ুবিকাশজনিত শিশুদের সুবিধাবঞ্চিত হওয়ার কারণ চিহ্নত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অটিজম ও স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যা শনাক্ত না করা। সমস্যা অনুযায়ী কার্যকর ও যৌক্তিক ব্যবস্থাপনার অভাব। অটিজম ও স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যাগ্রস্ত শিশুদের একীভূত শিক্ষার আওয়াত না আনা। বিদ্যালয় কর্তৃক ভর্তির উদ্যোগ না নেয়া। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অটিজম ও স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যাগ্রস্ত শিশুদের জন্য রাষ্ট্রীয় সুবিধাদি নিশ্চিত না করা। বিভিন্ন সময়ে জারিকৃত সরকারি আইন ও বিধিমালা সম্পর্কে অবহিত না থাকা। অটিজম ও স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যাগ্রস্ত শিশুদের অভিভাবক ও জনসাধারণের সচেতনার অভাব।সমান সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য জরিপে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হলো শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পরিহার করা। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত সকলকে প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি অবজ্ঞা দূর করা। বিদ্যালয় ক্যাচমেন্ট (সেবা) এলাকার সকল অটিজম ও স্নায়ুবিকাশজনিত শিশুর ভর্তি নিশ্চিত করা। ভর্তি হওয়া অটিজম ও স্নায়ুবিকাশজনিত শিশু যাতে ঝরে না পড়ে তার ব্যবস্থা করা। অভিভাবকদের সচেতন করা এবং অটিজম ও স্নায়ুবিকাশজনিত শিশুর শিক্ষা বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা।শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজগুলোতে কর্মরত প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষণ বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিছু শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে বদলি। মাধ্যমিক স্তরে বিদ্যালয়ে অটিজম ও স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও নমনীয় কারিকুলামের ব্যবস্থাকরণ। অটিজম ও স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের শিখনে সহায়তা করার জন্য উপযোগী শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত ও বিতরণের ব্যবস্থাকরণ।শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, প্রতিবন্ধী শিশুরা রাষ্ট্র ও সমাজের বোঝা নয়। তাদের সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় অটিস্টিক একাডেমি স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলছে। এর মাধ্যমে প্রতিবন্ধী শিশুদের একীভূত শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিত করা হবে।তিনি আরো বলেন, অটিজম শিশুদের পাঠদানে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা হচ্ছে। আগামীতে অটিস্টিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইউনিট গড়ে তোলা হবে। এর মাধ্যমে দেশের সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থা ও একীভূত শিক্ষা প্রদ্ধতি, প্রক্রিয়া ও কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুত, প্রশিক্ষণ প্রদান এবং বিদ্যালয়ে তা সরবরাহ করা হবে। প্রসঙ্গত, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩’ এর ধারা-১৬ এর উপধারা ১(জ) এ বলা হয়েছে, শিক্ষার সর্বস্তরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি সাপেক্ষে, একীভূত বা সমন্বিত শিক্ষায় অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে।১(ড)- অনুযায়ী শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রসহ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য উপযোগী পরিবেশ ও ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান। ধারা ৩৩ এর উপধারা-১ অনুযায়ী শুধু প্রতিবন্ধকতার কারণে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান উক্ত ব্যক্তির অন্যান্য যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভর্তির আবেদন প্রত্যাখান করতে পারবেন না।এছাড়া শিক্ষানীতি-২০১ এ একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়নে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বাধামুক্ত অংশগ্রহণের নির্দেশনা রয়েছে।এনএম/বিএ
Advertisement