আহমেদ ফেরদৌস আল জাজিরার সাম্প্রতিক ১ ঘণ্টা ১ মিনিটের রিপোর্টটি ৫/৬ বার ইংরেজি বাংলায় শুনে কিছু প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। মানুষের মনের সেই কিন্তুগুলো নিয়েই আজকের আলাপচারিতা। আল জাজিরার এই রিপোর্ট আদতেই একটি ব্রেকিং নিউজ বটে। তবে If যদি is হয়, But কিন্তু What কি- এর মতন।
Advertisement
এই রিপোর্টটি প্রকাশের ৩/৪ দিন পর ব্যবসায়িক কাজে বাইরে যাওয়ার সময় আমার গাড়ির চালক যে একজন ৮ম শ্রেণি পাস যুবক যার আদব কায়দা প্রশংসনীয় এবং সে যথেষ্ট রাজনৈতিক সচেতন একজন আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি, তার একটি কথায় আমার মাথায় ৪৪০ ভোল্টের বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেল। যাত্রাপথে আমি সাধারণত চালকের সাথে তেমন কথা বার্তা বলি না, কারণ এতে তার মনোনিবেশের ব্যাঘাত ঘটবে। কিন্তু সে উসখুস করছিলো কিছু বলার জন্য। আমি তার এই অস্বাভাবিক আচরণে তাকে প্রশ্ন করলাম, “ তুমি কি কিছু বলতে চাও আমাকে?“ সাথে সাথেই সে বললো ´ হ্যাঁ স্যার।
অতঃপর সে প্রশ্ন করলো, “ আচ্ছা স্যার, আল জাজিরা বাংলাদেশকে নিয়ে এই সময় কেন এই রিপোর্টটি করলো?” আমি বললাম, তুমি কোথা হতে শুনলে? সে আমাকে যা বললো, তার সারসংক্ষেপ হলো, আমাদের বাসার নিচে আমাদের দারোয়ান চাচা, তিন তালার ড্রাইভার এর আলাপ হতে শুনে সে তার স্মার্ট ফোন দিয়ে ইউটিউব থকে শুনেছেন। আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তুমি কি সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি শুনেছো? তার হ্যাঁ সূচক উত্তরে আমি বললাম, তুমি ইংরেজি ভাষা বুঝতে পারো? তার সরল উক্তি ছিল, না স্যার, কিন্তু এটার বাংলা আমরা সবাই একত্রে শুনেছি। তখন আমি তার প্রথম প্রশ্নটির উত্তরে বললাম, হয়তো আল জাজিরা তাদের রিপোর্টটি শেষ না করে প্রকাশ করেনি। সময়টা কি খুব মুখ্য? সে উত্তরে বললো, না স্যার, আমাদের সেনাপ্রধান যখন আমেরিকায় সফররত, তখন কেন এই রিপোর্ট প্রকাশ করলো আল জাজিরা? আমি তাকে বললাম, তোমার কি মনে হয়? সে বললো, স্যার বুঝতে পারছিনা বলেই তো আপনাকে জিজ্ঞেস করছি ও বুঝতে চাচ্ছি। আমি ইচ্ছে করেই আলাপটি আর আগে বাড়ালাম না। কিন্তু আমি খুশি হয়েছি তার কৌতূহল দেখে।
আমি আপনাদের সকলের সদয় অবগতি এবং বুঝার জন্য পরিষ্কার করেই এলান দিচ্ছি যে, আল জাজিরার রিপোর্টের পক্ষে বা বিপক্ষে কোন বক্তব্য দিতে আজ লিখতে বসিনি। আমার আপত্তির জায়গা হলো আমার দেশ এবং আমার দেশের সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান আমাদের সার্বভৌমত্ব এবং অহংকারের প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইমেজ জনমনে এবং বিশ্ববাসীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোন অধিকার কারো কি আছে?
Advertisement
আমার ছোটবেলা কেটেছে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলী শহরে আমার প্রয়াত বাবার সরকারি চাকুরির কল্যাণে (১৯৭৭ হতে ১৯৮৩ সন পর্যন্ত)। আমরা প্রতি বছর ছুটিতে বাংলাদেশে আসার পথে সউদি আরব হয়ে আসতাম। আমার ফুফাতো ভাই কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন অধ্যাপনা করতেন এবং জেদ্দায় তাদের বাসস্থান ছিল। আমরা ওমরাহ পালন করতাম প্রতিবার। আমার পরিষ্কার মনে আছে সে সময় জেদ্দাহ বিমান বন্দরে ইমিগ্রেশনে বিশাল লম্বা লাইনে সৌদি পুলিশদের হাতে পাকিস্তানিরা কিছু গুঁজে দিলে লাইন ছাড়াই দেখেছি তাদের ইমিগ্রেশন অতিক্রম করতে দিত।
দুর্নীতি নিয়ে কথা বলছি। আমরা সকলেই জানি যে সৌদি জনগণের আয় রোজগার সেই সময় তখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক অনেক বেশি ছিল। ভাববেন না, আমি বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ে সাফাই গাচ্ছি। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশ কেবল নয়, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোও দুর্নীতির ছোঁয়ামুক্ত নয়। আধুনিক মালয়েশিয়াতেও স্পিড মানি প্রথা ছিল। মালয়েশিয়া, কানাডাসহ আধুনিক বিশ্বের দেশগুলো কিভাবে জ্ঞানতঃ অবৈধ আয় তাদের দেশে বিনা প্রশ্নে প্রবেশের সহায়ক ভূমিকা পালন করে? বেগম পাড়া যেখানে প্রসিদ্ধ বাংলাদেশী পি কে হালদার এবং ব্যাংকের টাকা লুটেরাদের কল্যাণে, সেখানে আল জাজিরা কেন একটি অনুসন্ধানীমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে আগ্রহী নয় এই বিষয়ে? চুরি বা ডাকাতি বিশ্বের যে দেশেই সংঘটিত হোক না কেন, তা চুরি বা ডাকাতি। চুরি ডাকাতিতে শ্রেণি বৈষম্য করা যায় কি?
বাংলাদেশের সেনাপ্রধান একটি প্রতিষ্ঠান, একজন ব্যক্তি নন। তাঁকে Disgrace/Malign করার অপচেষ্টা মানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে খাটো করা। যেই সেনাবাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বিশ্বের ১ নম্বর Contributing Nation এবং বিশ্বের শান্তি রক্ষায় অগ্রণী কাণ্ডারির ভূমিকায় নেতৃত্ব দিচ্ছে, যেই সেনাবাহিনী মহামারি করোনায় বাংলাদেশের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের উন্নত দেশের স্বাস্থ্য সেবাকে টেক্কা দিয়ে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় বিপ্লব সাধন করেছে, যেই সেনাবাহিনীর কল্যাণে ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র হাতিরঝিল প্রকল্প টেন্ডারকৃত মূল্যের অর্ধেক দামে প্রকল্প গুণগত মান সম্পন্ন করে সম্পন্ন করেছে, যেই সেনাবাহিনী ঢাকা শহরের মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার হতে মাওয়া সুপার এক্সপ্রেস সড়ক দিয়ে ১৫০ কিমি গতিবেগে মাত্র ২৭ মিনিটে পৌঁছে দেবার মতো অকল্পনীয় কর্ম সমাধান করেছে, তাদের চরিত্র হননে হঠাৎ কেন একটি চক্র মরিয়া?
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ১৯৮১ সনে যখন দেশে প্রত্যাবর্তন করেন ইতিহাসের জঘন্যতম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে খুন হয় জাতির জনক পরিবারের সবাই, তখন রাষ্ট্র কিংবা পুলিশ তো বঙ্গবন্ধুর কন্যার নিরাপত্তা দেয়নি? তখন আজকের বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধানের এক ভাই এবং আওয়ামী লীগের কিছু নিবেদিত কর্মী (হাইব্রিড কর্মী নয় কিন্তু) স্বীয় জীবন বাজি রেখে শেখ হাসিনা তথা আওয়া লীগ সভাপতির জীবন রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়ে কোন হালুয়া রুটির আশায় নয়, বরং প্রাণের ডাকে কিংবা আদর্শিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে। সেই ব্যক্তিগুলোর মাঝে একজন বর্তমান সেনাপ্রধানের আপন ভাই। এটা কি সেনাপ্রধানের দোষ?
Advertisement
কেন, এই দেশে শীর্ষ সন্ত্রাসী বা অপরাধীদের কেউ কি মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সাধারণ ক্ষমার সুযোগপ্রাপ্ত হয়নি? ফ্রিডম পার্টির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির রায় পুনর্বিবেচনা করা কি একটি মহলে নীতিবহির্ভূত গর্হিত অপরাধ? অনুগ্রহ পূর্বক আমার এই যুক্তি উপস্থাপনকে কেউ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রহণ না করে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে স্বীয় বিবেচনায় নিজ বিবেককে প্রশ্ন করলে বাধিত হবো।
লেখার প্রথমেই আমি শপথ করেছিলাম, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব বা আমার দর্শন এখানে বিবেচনায় আনবো না। চেষ্টা করেছি শপথ ভঙ্গ না করার। বাংলাদেশের দুর্নীতি এবং সকল প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো সম্পূর্ণ ওভার হলিং যেমন আমি চাই, তেমনি ভুলে যেতে চাই না হাওয়া ভবন, প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলের প্রেসিডেন্ট সাহেবের ফ্রান্স হতে স্যুট আনার কথা।
আমাদের সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে যখন অনিয়ম, অবিশ্বাস, মূল্যবোধের অবক্ষয়, দুর্নীতিতে সকলে যখন আমি আপনি এবং আমরা প্রায় সকলেই আকণ্ঠ নিমজ্জিত, তখন আপনি সমাজের এই পচনরোধ ব্যতিরেকে কিভাবে আশা করেন সাফ সুতেরো পবিত্রতা?
এই কি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদি আল জাজিরার অবস্থান?
একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি চাই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই রিপোর্ট যারা করেছে জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক আইনে তাদের বিচার হোক। সাথে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ৩০,০০০ মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে, Weapon of Mass Destruction এর মিথ্যে অজুহাতে ইরাকি ব্যাবিলন সাম্রাজ্যে গণহত্যা এবং মিয়ানমার কর্তৃক লাখ লাখ গণহত্যার বিচারিক প্রক্রিয়াও একত্রে শুরু হোক। যদি কেউ বা কোন রাষ্ট্র বা কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা তা করতে পারেন, তবে বুঝবো হেতেনেরা বাপের ব্যাটা কুদ্দুস।
এইচআর/জেআইএম