বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জেলজীবনের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে গতকাল, ৮ ফেব্রুয়ারি । অবশ্য তিনি এখন সরকারের বিশেষ অনুকম্পায় জেলের বাইরে আছেন। গত বছর ২৬ মার্চ তিনি জামিনে মুক্তি পান। তার পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার শাস্তি স্থগিত রেখে তাকে ছয় মাসের জন্য জামিন দেওয়া হয়। পরে জামিনের মেয়াদ আরো ছয় মাস বাড়ানো হয়। এই মেয়াদও শেষের পথে। তার জামিনের মেয়াদ বাড়িয়ে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে পাঠানোর অনুমতি চেয়ে সরকারের কাছে নতুন আবেদন করার প্রস্তুতির খবর জানা গেছে। বেগম জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তৎপরতা চলছে। জামিন পাওয়ার আগে কয়েক মাস ধরে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। জামিন পাওয়ার পর থেকে তিনি গুলশানে তার ভাড়া বাড়িতে আছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে কেউ অবশ্য খালেদা জিয়াকে নিয়ে কোনো কথা বলেন না।
Advertisement
দুটি দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার মোট ১৭ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। তাকে সাজা দেওয়া হলে কিংবা জেলে পুড়লে সরকার বড় ধরনের চাপে পড়বে, দেশের ভেতর তার মুক্তির দাবিতে প্রবল আন্দোলন গড়ে উঠবে, বিদেশ থেকেও তার মুক্তির জন্য সরকারের ওপর চাপ আসবে বলে বিএনপি নেতারা আশা করলেও বাস্তবে তেমন কিছুই হয়নি। দলীয় প্রধানের মুক্তির দাবিতে বিএনপি বড় কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।
দলীয় কর্মী-সমর্থকরাও সেভাবে রাস্তায় নামেনি। মামুলি কিছু সভা-সমাবেশ-মানববন্ধনের কর্মসূচি বেগম জিয়ার মুক্তি আন্দোলন কার্যত গতি পায়নি। তাকে টানা ২৫ মাস জেলে কাটাতে হয়েছে। শারীরিক অসুস্থতার জন্য তাকে মুক্তির দাবি জানানো হলেও তা সরকার বিবেচনায় নেয়নি। সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে খালেদা জিয়ার মুক্তির কোনো সম্ভাবনা না দেখে পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ করা হয়। তার মুক্তির কৌশল নিয়ে পরিবারের সঙ্গে দলের মতভিন্নতার কথাও তখন শোনা গিয়েছে। মুলত পরিবারের চেষ্টায়ই তাকে জামিন দেওয়া হয়।
বিএনপি নেতারা বড় বড় বুলি কপচালেও বাস্তবে তারা যে কতটা 'অসহায়' সেটা মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়েছে? বেগম জিয়াকে জেলে নেওয়া হলে মানুষ সুনামির মতো রাস্তায় নেমে আসবে বলে বিএনপি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিল। সেদিনই লিখেছিলাম, 'খালেদা জিয়ার সাজা হলে নাকি মানুষ সুনামির মতো রাজপথে নেমে আসবে! আজ তো এলো না। কাল বা পরশু আসবে কি? না, মানুষ রাস্তায় নামেনি। এমনকি বিএনপির নেতাকর্মীরাও কোনো ঝুঁকি নেননি।
Advertisement
বেগম জিয়ার শাস্তিকে রাজনৈতিক চরিত্র দেওয়ার চেষ্টা কম হয়নি। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো ফল পাওয়া যায়নি। 'দুর্নীতিবাজ' হিসেবে দণ্ডিত একজন নেত্রীকে রক্ষার জন্য মামুষ আন্দোলন করবে-এটা বিশ্বাসযোগ্য ছিল না । তাছাড়া ক্ষমতায় থেকে বিএনপি এমন কিছু করেনি যার জন্য মানুষ বিএনপিকে অন্তরে ঠাঁই দিয়েছে। তারপর ক্ষমতার বাইরে থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে বেগম খালেদা জিয়া যে সন্ত্রাস-সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেটাও তার প্রতি সাধারণ মানুষকে বিরাগ করে তুলেছিল। এমনকি বিএনপি সমর্থকদের মধ্যেও দেখা দিয়েছিল প্রশ্ন এবং বিভ্রান্তি। মানুষের প্রকৃত মনোভাব বুঝতে না পেরে বিএনপি নেতারা দলের জনপ্রিয়তা নিয়ে ভুল হিসাব করেছে। তারেক রহমানকে নিয়েও বিএনপি তথা খালেদা জিয়া ঠিক পথে এগুতে পারেননি। তারেক রহমানকে বিএনপির ‘ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা মানুষের কাছে ভুল বার্তা দিয়েছে। তার যে ইমেজ মানুষের সামনে গড়ে উঠেছে সেটা ইতিবাচক ছিল না।
‘হাওয়া ভবন' নামের ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র গড়ে তুলে তারেক মানুষের মনে ভীতি তৈরি করেছেন, ভালোবাসার জায়গা তার জন্য কম মানুষের মনেই তৈরি হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টাসহ নানা জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের সঙ্গে তারেকের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় তাকে নিয়ে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণাই বেশি হয়েছে। নিজেদের নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য তারেক রহমানকে অনেকেই ‘যোগ্য’ নেতা মনে না করলেও তাকেই যখন দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হিসেবে দলের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন বিএনপি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার কাজটি করে। তারেক যে দলের জন্য সম্পদ নয়, বোঝা সেটা বুঝতে না পারার খেসারত বিএনপিকে দিতে হচ্ছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর জন্য নির্বাচনের ওপর ভরসা না করে বিএনপি সব সময় ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা তথা নানা ধরনের অন্ধকার গলি পথের সন্ধান করতে থাকায় দেশে সুস্থ ধারার রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষকে অসত্য তথ্য প্রচার করে, মানুষের সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টির অব্যাহত চেষ্টা বিএনপিকে এখন এক বিশেষ অবস্থার মধ্যে ফেলেছে।
দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে পারবে না বলে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগবিরোধী সব মহল থেকে একটানা কোরাস গাওয়া হলেও মানুষ কেন রাস্তায় নামে না, এটা বোঝার চেষ্টা তাদের করতে হবে। জোরজুলুমই কি আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার একমাত্র শক্তি? নাকি রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জনকল্যাণের কর্মসূচি শেখ হাসিনার পায়ের নিচে শক্ত ভিত্তি তৈরি করছে, সেটাও ভাবতে হবে। মানুষ এখন আর বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা পছন্দ করে না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে কারা ক্ষমতায় আসবে এবং তারা এরচেয়ে কীভাবে উন্নত ও ভালো শাসন উপহার দেবে, সেটা না বুঝে মানুষ আর মাঠে নামবে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক কৌশলে বারবার পরাজিত হয়ে হুঙ্কার ছাড়ার রীতিটাও পরিহার করা দরকার। বিএনপির এসব নিয়ে কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।
Advertisement
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে পাঠানোর একটি উদ্যোগ তার পরিবারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে বলে একটি খবর ‘ভোরের কাগজ' ৮ ফেব্রুয়ারি ছাপা হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার কথাও ওই খবরে বলা হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে : ‘ সরাসরি রাজনীতি থেকে অবসরের কথা না বললেও খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যেতে সরকারের পক্ষ থেকে দুটি শর্তের কথা জানানো হয়েছে।
প্রথমত, লন্ডনে গিয়েও চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়া প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে পারবেন না। গুলশানে যেভাবে বাস করছেন, লন্ডনেও ঠিক তেমনি থাকবেন। দ্বিতীয়ত, বিদেশিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ থেকে বিরত থাকবেন। লন্ডনে থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক বক্তব্য-বিবৃতি দেয়া ও সভা-সমাবেশে যোগদান থেকে বিরত থাকা এবং নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন না। এক্ষেত্রে খালেদার পরিবার চায় শর্ত মেনেই চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাবেন তিনি। তবে খালেদা চান শর্ত ছাড়াই লন্ডনে যেতে'। খবরে আরো বলা হয়েছে : ‘জানতে চাইলে খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম বলেন, জামিনের পর তিনি (খালেদা) এখনো পর্যন্ত কোনো শর্ত ভঙ্গ করেননি। তাই এ ব্যাপারে সরকার কঠোর হবে না’।
বেগম জিয়া যদি সরকারের শর্ত মেনে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান, তাহলে বিএনপি কি করবে? বিএনপি কি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের গীত গাইতেই থাকবে? মানুষ কি তাদের আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেবে? আন্দোলনের নামে দেশে নতুন করে সংঘাত-সহিংসতা কি মানুষ চাইবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা না থাকলেও গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, মানুষ কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতার জন্য প্রস্তুত নয়। মানুষ কি দেখছে? বিএনপি গর্জন করে, বর্ষণ হয় না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ গর্জনে-বর্ষণে সমান। বিএনপি ক্ষমতায় থেকেও পারে না, বিরোধী দলে থেকেও না। আওয়ামী লীগ দুই ক্ষেত্রেই সমান সক্ষম।
যে কেউ আওয়ামী লীগকে অপছন্দ করতে পারে, কিন্তু উপেক্ষা করতে পারবে না। কেউ বিএনপিকে অপছন্দও করতে পারে, আবার উপেক্ষাও করতে পারে। তাতে কোনো সমস্যা হয় না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি নিজেকে অপরিহার্য প্রমাণ করতে পারেনি এখনও।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবশ্য পাঠ্য বিষয়ের মতো আর বিএনপি চতুর্থ বিষয়ের(ফোর্থ সাবজেক্ট) মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থা দূর করার জন্য যে রাজনৈতিক উদ্যোগ ও পরিকল্পনা দরকার তার ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে না পারলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সহজ হবে বলে মনে হয় না।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এইচআর/জেআইএম