ড. বদিউল আলম মজুমদার। নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের।
Advertisement
প্রতীকের মধ্য দিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়ায় রাজনৈতিক সঙ্কট আরও বাড়ছে বলে অভিমত তার। রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণে নাগরিক অধিকার সংকুচিত হচ্ছে, এমনটিও মনে করেন তিনি। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ পড়ুন শেষটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ: আগের পর্বে নাগরিক সমাজের বিভাজনের কথা বলছিলেন, যেখানে ফায়দাভিত্তিক রাজনীতিকে দায়ী করেছেন। আসলে কি এই বিভাজনের জন্য রাজনীতিই একমাত্র কারণ?
বদিউল আলম মজুমদার: রাজনীতিই একমাত্র কারণ আমি তা মনে করি না। গোটা পৃথিবীতেই এ ধারা সৃষ্টি হয়েছে।
Advertisement
এক সময় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করতে সাঁজোয়া যানে করে আসতো (একটি শক্তি)। এখন আর সেই সাঁজোয়া যান দিয়ে গণতন্ত্র ধ্বংস করতে হচ্ছে না। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়েই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আড়াইশ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি, যা ক্যাপিটল হিলে হামলার মধ্য দিয়ে ঘটল। ডোনাল্ড ট্রাম্প কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন।
জাগো নিউজ: নিরাশার এই ঘোরে আশার বাণী কী হতে পারে?
বদিউল আলম মজুমদার: উপলব্ধির বিষয়। রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে নৈতিকতার বোধ জাগ্রত না হলে নিরাশার ঘোর কাটবে না। নেতারা যদি সঠিক পথে ফিরে আসেন তবেই মুক্তি মিলবে।
একই উপলব্ধি আসতে হবে নাগরিক সমাজের মনেও। নাগরিক সমাজের দায় হচ্ছে, জনগণকে সচেতন করে তোলা। মানুষ যদি তার অধিকার নিয়ে জাগ্রত হতে পারে তবেই রাজনৈতিক পরিবর্তন আসবে।জাগো নিউজ: নাগরিক জাগ্রত হচ্ছে না। তার মানে জনমনে স্বস্তি আছেই?
Advertisement
বদিউল আলম মজুমদার: দেশ মহাসঙ্কটের মধ্যে আছে। বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নেতা বানিয়েছেন এই আত্ম-অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাই হয়েছে গণতন্ত্র, ভোটের অধিকারের মধ্য দিয়ে। অথচ সে অধিকার পরিকল্পিতভাবে হরণ করা হলো। এটি জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হলো। নাগরিকরাও এজন্য দায়ী। যদিও তারা গণতান্ত্রিক পরিবেশই পায়নি।
যারা তরুণ জনগোষ্ঠী তারা হিংসার রাজনীতি ছাড়া কিছুই দেখেনি। রাজনৈতিক অধিকার মানেই তারা মনে করছে আন্দোলন। অথচ আন্দোলন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়।
জাগো নিউজ: এর পরিণতি কী?
বদিউল আলম মজুমদার: যে সঙ্কট চলছে, তার উত্তরণ না ঘটলে পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। কারণ গণতন্ত্রের সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে।জাগো নিউজ: এর বিপরীতেও আলোচনা আছে। সরকার যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, উন্নয়ন প্রশ্নে সরকার-জনগণ উভয়ই স্বস্তিতে।
বদিউল আলম মজুমদার: মানুষের মনে ক্ষোভ-উদ্বেগ আছে। জেলখানায় সব প্রয়োজন মিটিয়ে রাখলেই কি মানুষ সেখানে স্বস্তিতে থাকে? এটি বুঝতে পারার ব্যাপার। মানুষ এভাবে বেঁচে থাকতে পারে না। আরও অনেক ব্যাপার আছে। মানুষের অনেকগুলো চাহিদা আছে, যা রাজনৈতিক, সামাজিকভাবে মেটাতে হয়। এই চাহিদা মেটাতে না পারলে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। অসন্তোষ প্রকাশের পথ বন্ধ হলে ভয় আরও বাড়ে।
গণতান্ত্রিকভাবে মানুষ তার মতের প্রকাশ ঘটাতে না পারলে ধর্মভিত্তিক সমাধানের দিকে যেতে চায়। উগ্রবাদের বিকাশ এভাবেই ঘটে। আপাতত ধামাচাপা দিয়ে সরকার ভালো অবস্থানে রেখেছে। ভালো। কিন্তু যে কোনো সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। গণতন্ত্র না ফিরলে মানুষ ধর্মভিত্তিক সমাধানে যাবে।
নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না ধারাবাহিকভাবে। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদল হবেই একদিন। তখন কী ঘটবে, সেটাই ভাবনার বিষয়। ১/১১-এর ইতিহাস বেশি পুরনো নয়।
জাগো নিউজ: আলোচনা হচ্ছিল দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রসঙ্গ নিয়ে।
বদিউল আলম মজুমদার: স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিরোধী দল দুর্বল থেকে দুর্বল হয়ে পড়ছে। তবু যেখানে কিছুটা শক্তি দেখাতে পারছে, সেখানে বিরোধী দল এবং সরকারি দলের মধ্যে সংঘাত হচ্ছে। সব জায়গায়ই সরকারি দলের নিজেদের মধ্যে মারামারি হচ্ছে। এটি আরও বাড়বে সামনে। কারণ ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে সবাই মরিয়া।
আপনি উন্নয়নের কথা বললেন। দৃশ্যমান উন্নয়ন হচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। ধার করে ব্যয় করা হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত উন্নয়ন কি হচ্ছে? মানুষের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। টাকা পাচার হচ্ছে। দুর্নীতির ব্যাপকতা বাড়ছে। আসলে গণমানুষের উন্নয়ন হচ্ছে না। অর্থভিত্তিক উন্নয়নই একমাত্র পথ নয়।
জাগো নিউজ: কিন্তু দৃশ্যমান উন্নয়নকে কি একেবারেই অস্বীকার করা যায়?
বদিউল আলম মজুমদার: না। এটি কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু অবকাঠামো উন্নয়নকেই একমাত্র উন্নয়ন বলে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে। এর আড়ালে অনেক কিছুই চাপা পড়ে যাচ্ছে।
আর্থ-সামাজিকভাবে উন্নয়ন না ঘটলে জনসাধারণ তুষ্ট থাকতে পারে না।
এএসএস/এইচএ/জিকেএস