হার অথবা জিত, দুটো শব্দই খেলার সাথে জড়িত। যে কোনো খেলায় একদল জিতবে অন্য দল হারবে এটাই স্বাভাবিক। কাজেই খেলায় হার অথবা জিত নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো মানে হয় না। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট দল টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে যে ভাবে হেরে গেল সেটা কী খুবই স্বাভাবিক ঘটনা? এটাই কী হওয়ার কথা ছিল? সকালের সূর্যই বলে দেয় দিনটা কেমন যাবে। তেমনি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পারফরমেন্স দেখে কি আদৌ মনে হয়েছিল বাংলাদেশ চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে মর্যাদার লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত পর্যুদস্ত হবে? ৩৯৫ রানের লিড নেয় যে দল তারই তো জিতে যাওয়ার কথা!
Advertisement
যদিও ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা। তবুও ৩৯৫ রানের লিড নিয়ে বাংলাদেশ জয় না পাক খেলায় ড্র হলেও তো একটা স্বস্তির ব্যাপার দাঁড়াত। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সম্ভাবনার শীর্ষে দাঁড়িয়েও কেন শেষ পর্যন্ত জয়ের মুখ দেখলো না? এর ব্যাখ্যা কী? ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা। কাজেই যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো অঘটন ঘটতেই পারে- আমরা কী এ ধরনের যুক্তিতর্ক সামনে দাঁড় করিয়ে পরিস্থিতি সামলে নেবার চেষ্টা করবো? নাকি কার্যকর কোনো আলোচনায় যাব যে, কেন এই অঘটন হলো? দায়টা কার? মাঠে নেমে সবাই জেতার জন্যই খেলে। সেখানে প্রতিপক্ষের শক্তিটাও বড় কথা!
ওয়েস্টইন্ডিজ ক্রিকেট দল হিসেবে এখন আর বাংলাদেশের জন্য কঠিন প্রতিপক্ষ নয়। এটা ভেবেই কী আমরা একটু বেশী নির্ভার ছিলাম? ৩৯৫ রানের লিড নিয়েছি। কাজেই হেসে খেলে জিতে যাব এমন ভাবনাই কী আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল? একটি পত্রিকায় দেখলাম জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও ইউকেট কিপার শফিকুল হক হীরা টেস্টের এই হারের জন্য টিম ম্যানেজমেন্টকে দায়ী করেছেন। তার মতে, ৩৯৫ রানের লিড নেয়ার পর বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ধরেই নিয়েছিল তারা জিতে যাচ্ছে। সে কারণে মাঠে সিনিয়র খেলোয়াড়দের অনেকের মনো সংযোগে ঘাটতিও ছিল। এই ‘ধরে নেয়া’ মনোভঙ্গিই শেষ পর্যন্ত ‘কাল’ হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। জিততে জিততে হেরে গেছে বাংলাদেশ।
আবারও বলি, খেলায় হার ও জিত দুটোই থাকে। সেখানে লড়াই করে হারলে মর্যাদা এতটুকু কমে না। ক্রিকেট বাংলাদেশের মানুষের জন্য এমন একটি খেলা, যে খেলার জয় পরাজয় নিমিষেই দেশের সকল মানুষের মাঝে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে ক্রিকেটই এখন পর্যন্ত একমাত্র খেলা যার জন্য দল মত নির্বিশেষে দেশের মানুষ সর্বদাই ঐক্যবদ্ধ ভ‚মিকা পালন করে। ক্রিকেট হাসলে বাংলাদেশ হাসে। ক্রিকেট ব্যর্থ হলে গোটা দেশে শোকের ছায়া নামে। করোনার আতংকে টানা প্রায় এক বছর মাঠের ক্রিকেট সরব ছিল না। আশার কথা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বাংলাদেশে খেলতে আসায় মাঠের ক্রিকেট আবার সরব হয়েছে। ক্রিকেট আনন্দ দেশের জন-জীবনে স্বস্থির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। চট্টগ্রামে বাংলাদেশ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট খেলা নিয়ে ব্যাপক আগ্রহও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েিেছল সারাদেশে। বাংলাদেশ নিশ্চিত জিতে যাচ্ছে এমনটাই ভেবেছিল সবাই। কিন্তু বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত হেরে গেল। আশাহত দেশের মানুষ। সাধারন মানুষের মুখেও অনেক প্রশ্নÑ ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা। তাই বলে জিতে যাওয়া খেলা হেরে যাবে বাংলাদেশ? এর ব্যাখ্যা কী?
Advertisement
ক্রিকেট পণ্ডিতরা নিশ্চয়ই এর কার্যকর ব্যাখ্যা খুঁজে বের করবেন। আমি ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ নই। ক্রিকেট ভালোবাসি। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল হেরে যাচ্ছে বুঝতে পেরেও টিভির পর্দা থেকে চোখ সরাতে পারি না। কিন্তু এবারের ক্রিকেটের হার একজন দর্শক হিসেবে আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। টেস্ট খেলতে নামা ওয়েস্টইন্ডিজের নতুন খেলোয়াড় মেয়ার্স যেন একাই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। তার কাছে বাংলাদেশের বোলারদের বেশ অসহায় মনে হচ্ছিলো। ক্রিকেটে যে কোনো দিন কোনো দলের নতুন খেলোয়াড়ও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। তাকে পরাস্ত করার টেকনিক দেখাতে না পারলে বিরোধী পক্ষের সামর্থ্য নিয়ে অনেক প্রশ্ন ওঠে। যেমন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সামর্থ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের টেস্ট অধিনায়ক মমিনুল হকের ওপর একটি রিপোর্টে বিস্ময়কর হেড লাইন ছাপা হয়েছে। ‘অপ্রত্যাশিত হারে হতচকিত মমিনুল’। রিপোর্টের শুরুটা এমন- “দূরতম কল্পনায়ও যা ছিল না। সেটিই এখন প্রবল বাস্তব। কঠোর সেই বাস্তবতা মমিনুল হকদের যেন হতবিহব্বলই করে দিয়েছে। এই ম্যাচেও যে হারা সম্ভব, যেন বিশ্বাসই হতে চাইছে না বাংলাদেশের অধিনায়কের।”
রিপোর্টে মমিনুল হকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘মাঠে সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন তিনি। সাকিব ভাই থাকলে বোলিং অনেক গোছানো হতো। যেহেতু সিনিয়র বোলার ও ব্যাটসম্যান, সবাইকে আগলে রাখতে পারতাম। উনি না থাকায় মিস করেছি, বিশেষ করে বোলিংয়ে।’ টেস্ট অধিনায়ক মমিনুল হকের কথায় দারুণ একটা অসহায়ত্বের ছবি ফুটে উঠেছে। “সাকিব ভাই থাকলে বোলিং অনেক গোছানো হতো।” তার মানে সাকিব না থাকায় দলের এই ভরাডুবি? কিন্তু সাকিব যদি আবারও ইনজুরিতে পরেন, আবারও মাঠে নামার সুযোগ না পান তখন ভবিষ্যতে কি হবে? নতুন সাকিবকে খুঁজে নেয়ার কার্যকর উদ্যোগ আছে কী ক্রিকেট বোর্ডের?
আরেকটি দৈনিক লিখেছে “অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর মমিনুল চট্টগ্রাম টেস্টেই প্রথম পূর্ণ শক্তির দল পেয়েছেন। নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরা সাকিব আল হাসান দলে আছেন। সাথে আছেন তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমও। প্রথম ইনিংসেই চোটের কারণে সাকিব ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়েন। শেষ দিনে তামিমও মাঠে ছিলেন না অধিকাংশ সময়। মুশফিক ছিলেন কখনো ফাইন লেগে, কখনও থার্ড ম্যানে। চাপের মুখে মমিনুলকে মাঠে বেশ একাই মনে হয়েছে।”
Advertisement
অধিনায়ককে একা মনে হলে দলের পক্ষে লড়াই করার শক্তি কী সেই অর্থে জোরালো হয়? আবারও বলি খেলায় হার, জিত দুটোই আছে। কিন্তু চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কী সত্যিকার অর্থে পরস্পরে বিশ্বাসী দল হিসেবে খেলেছে? নাকি এই হারের পিছনে অন্য কোনো কারণ আছে? ক্রিকেটের উন্নয়নের স্বার্থে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। কারণ ক্রিকেট হাসলে বাংলাদেশ হাসে। এটাই সত্য। এটাই বাস্তব। জয় হোক বাংলাদেশের ক্রিকেটের।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।
এইচআর/জেআইএম