ফিচার

ধ্বংসের পথে সাড়ে ৩শ বছরের রায়েরকাঠি রাজবাড়ি

পিরোজপুরের রায়েরকাঠি রাজবাড়ি। জেলা শহর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে রায়েরকাঠিতে ২০০ একর জমি নিয়ে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী এ রাজবাড়ি। এখানে আছে ১৬৬৮ সালে নির্মিত কালী মন্দির, ১১টি মঠ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজবাড়ি। ধ্বংসপ্রাপ্ত এসব মঠ ও রাজবাড়ি দেখেই পর্যটকরা মুগ্ধ হতে বাধ্য।

Advertisement

প্রচারণা ও পর্যটন সুবিধা না থাকায় বাড়িটি দেখতে তেমন লোকের আনাগোনা হয় না। তবে প্রতিদিনই কিছু লোক আসেন এটি দেখতে। ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করেন সপ্তদশ শতাব্দীর মনোরম নির্মাণশৈলী।

ইট ও চুন-সুড়কি দিয়ে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তৈরি করা হয়েছে প্রাসাদ ও মঠগুলো। কালের বিবর্তনে ধ্বংসের পথে মূল রাজবাড়ির অধিকাংশ ভবন। তবে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৩৫৭ বছরের পুরোনো কালী মন্দির ও ৭৫ ফুট উঁচু ১১টি মঠ।

শোনা যায়, এরই একটি মঠে স্থাপন করা হয়েছে ২৫ মণ ওজনের একটি শিবলিঙ্গ। কষ্টি পাথরের তৈরি এ মহামূল্যবান শিবলিঙ্গটি উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় শিবলিঙ্গ বলে ধারণা করা হয়।

Advertisement

ইতিহাস গবেষক গোলাম মোস্তফার ‘সংগ্রামী পিরোজপুর’ বইয়ে পাওয়া যায়, ‘সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে যুবরাজ সেলিম বিদ্রোহ ঘোষণা করে বাংলায় আসেন। এরপর তিনি ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলার কিছু অংশ নিয়ে একটি পরগনা সৃষ্টি করেন। নিজের নামে নাম রাখেন সেলিমাবাদ।’

১৬১৮ সালে সেলিমাবাদ পরগনার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পান মদন মোহন। ১৬২৮ সালে তিনি তার ছেলে শ্রীনাথের নামে সেলিমাবাদ পরগনার কিছু জমি নেন। শ্রীনাথ ঝালকাঠির লুৎফাবাদ গ্রামে কাচারি স্থাপন করে বসবাস করতেন। এরপর মুঘল সম্রাট শ্রীনাথকে রাজা উপাধি দেন।

১৬৫৮ সালে রাজা শ্রীনাথ রায়ের ছেলে রুদ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী পিরোজপুরের অদূরে বসবাস শুরু করেন। পরে সেখানে তিনি জঙ্গল পরিষ্কার করে রাজবাড়ি ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বন-জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা হয় বলেই সেখানকার নামকরণ করা হয় রায়েরকাঠি।

রাজা রুদ্র নারায়ণ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় পাঁচজন নিম্নবর্ণের হিন্দুর মুণ্ডু কেটে তার ওপর মূর্তি স্থাপন করেন। রাজার এ নিষ্ঠুর ঘটনা ঢাকার প্রাদেশিক সুবেদার শাহবাজ খানের কানে পৌঁছালে রুদ্র নারায়ণকে মৃত্যুদণ্ড দেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য রুদ্র নারায়ণকে হাজার হাজার মানুষের সামনে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।

Advertisement

তবে খাঁচার মধ্যে লড়াই করে বাঘ মেরে ফেলেন তিনি। এ খবর সুবেদারের কানে গেলে রুদ্র নারায়ণের দণ্ড মওকুফ করেন। রুদ্র নারায়ণ তার কৃতকর্মে লজ্জিত হয়ে রাজবাড়িতে না ফিরে ছেলে নরোত্তম নারায়ণ রায়কে রাজত্ব বুঝিয়ে দিয়ে কাশি চলে যান। সেখানে তিনি আমৃত্যু সন্ন্যাস জীবন পালন করেন।

একসময় রাজপ্রথা বিলুপ্ত হলে চালু হয় জমিদারি প্রথা। এতে রাজা রুদ্র নারায়ণ রায়ের উত্তরসূরীরা পরিণত হন জমিদারে। ফলে রায়েরকাঠির এ ঐতিহাসিক স্থাপনাকে কেউ জমিদার বাড়ি, কেউ রাজবাড়ি বলে থাকেন। অমরেন্দ্র রায় চৌধুরী ছিলেন এ বংশের শেষ জমিদার।

সরেজমিনে জানা যায়, ভেঙে পড়ছে রাজবাড়ির প্রধান ফটক, প্রাসাদ, কাচারি, অতিথিশালা, নাট্যশালা, জলসাঘর, অন্ধকূপ ও মঠগুলো। নবরত্ন মঠসহ তিনটি মঠের কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে। ভবনের গায়ে শ্যাওলা ও লতাপাতা জন্মে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।

এলাকাবাসীর দাবি, প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর ঐতিহাসিক রাজবাড়ি ও মঠ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে একদিকে যেমন স্থানটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে; অন্যদিকে রায়েরকাঠি হয়ে উঠবে দেশের অন্যতম পর্যটন স্থান।

এসইউ/এমএস