বেশ কয়েক বছর আগে আমার এক স্কুলশিক্ষক অবসরে যান। অনেকেই হয়তো জানেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবসরভাতার টাকা আসতে বেশ সময় লাগত। এখনকার অবস্থা আমার জানা নেই। যাই হোক, একজন এমপিওভুক্ত স্কুলশিক্ষকের জন্য অনেক আরাধ্য এই অবসরভাতার টাকা। চেকটি নগদায়নের জন্য ব্যাংকে জমা দিলেন। দিনের মধ্যেই চেকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্লিয়ারিং হাউজ থেকে পাস হয়ে গেল। স্যারের ইচ্ছা, অবসরভাতার এই টাকা দিয়ে তিনি সঞ্চয়পত্র কিনবেন। নিয়মিত বিরতিতে নির্দিষ্ট কিছু মুনাফা পাবেন। অবসরজীবনে তিন মাস অন্তর ১৫/৪৬ হাজার টাকা পাবেন, সেটাও কম কিসের।
Advertisement
অবসরভাতার সম্পূর্ণ টাকা ব্যাংক থেকে তুলে অন্য একটি ব্যাংকে গেলেন সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য। সঞ্চয়পত্রের ফরম পূরণ করার পর যখন তিনি ছয় লাখ টাকা ক্যাশ কাউন্টারে জমা দিলেন, তখন ক্যাশ কর্মকর্তা সেই ছয় লাখ টাকার মধ্যে একটি ১০০০ টাকার নোট জাল শনাক্ত করলেন। তবে স্যারের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। টাকার বান্ডেলে ফ্লাই লিফ থাকার কারণে, ক্যাশ কর্মকর্তা টাকার বান্ডেল ফেরত দিলেন।
স্যার সেই টাকার বান্ডেল নিয়ে পূর্বের ব্যাংকে গিয়ে তার এক ছাত্র যিনি ওই ব্যাংকেরই কর্মকর্তা, তাকে ফ্লাই লিফ থাকা জাল নোটের স্ট্যাপেল করা বান্ডেল ফেরত দিলেন এবং সেটা পরিবর্তন করে স্যারকে নতুন টাকার বান্ডেল দেয়া হলো। কিন্তু এখানে যদি টাকার বান্ডেলে ফ্লাই লিফ না থাকত কিংবা প্রাক্তন ছাত্র যদি ব্যাংক কর্মকর্তা না হতো, তবে পাঁচ বছর অপেক্ষায় থাকার পর অবসরভাতার টাকার মধ্যেও জাল টাকা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হতো।
২০১৭ সালে ভারত মূলত যে তিনটি কারণে নোট বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একটি কারণ ছিল জাল নোট মুদ্রাবাজার থেকে দূর করা। কারণ জাল নোট সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ এবং মুদ্রাবাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলে। কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের রিপোর্ট মতে, হাজার রুপির প্রতি ১০ লাখ নোটের মধ্যে জাল নোট ধরা পড়ে ৩৫৭টি এবং ৫০০ রুপির প্রতি ১০ লাখ নোটের মধ্যে ধরা পড়ে ৩৬২টি।
Advertisement
জাল টাকা যেহেতু ছড়িয়ে রয়েছে, তাই আমাদের জানা উচিত আসল টাকার কিছু বৈশিষ্ট্য। অন্যথায় কষ্টের উপার্জিত টাকা কখন যে জাল টাকায় রূপ নেবে, তা আদৌ বলা যায় না। সাধারণ মানুষের কিছুটা সচেতনতার অভাব এবং জাল নোট কারবারিদের নিত্যনতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন এই সমস্যা সকলকেই ভাবিয়ে তুলেছে। প্রত্যেকেরই জানা উচিত আসল নোটের বৈশিষ্ট্যসমূহ। বড় নোটের ক্ষেত্রে জাল করার বিষয় জড়িত থাকে। এ জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত ১০০, ৫০০ এবং ১০০০ টাকা মূল্যমানের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সম্বলিত আসল ব্যাংক নোটের কিছু সহজ বৈশিষ্ট্য, যা খালি চোখে দ্রুত বোঝা যায়, আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন।
নোটটি সিনথেটিক ফাইবার মিশ্রিত অধিক টেকসই কাগজে মুদ্রিত হবে। নোটের ডানদিকে আড়াআড়িভাবে ইন্টাগ্লিও কালিতে সাতটি সমান্তরাল লাইন আছে। নোটের সামনের দিকে ইন্টাগ্লিও কালিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি মুদ্রিত আছে। ১০০০ টাকার নোটের ডানদিকে অন্ধদের জন্য পাঁচটি ছোট বিন্দু; ৫০০ টাকার নোটের ডানদিকে অন্ধদের জন্য চারটি ছোট বিন্দু এবং ১০০ টাকার নোটের ডানদিকে অন্ধদের জন্য তিনটি ছোট বিন্দু রয়েছে যা হাতের স্পর্শে উচু-নিচু অনুভূত হবে। নোটের বাম পাশে চার মিলিমিটার চওড়া নিরাপত্তা সুতা; যাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো ও ১০০/৫০০/১০০০ টাকা লেখা আছে; সরাসরি দেখলে লোগো ও ১০০/৫০০/১০০০ টাকা সাদা দেখাবে; কিন্তু পাশ থেকে দেখলে বা ৯০ ডিগ্রিতে নোটটি ঘুরালে তা কালো দেখাবে।
কাগজে জলছাপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি; প্রতিকৃতির নিচে অতি উজ্জ্বল ইলেকট্রোটাইপ জলছাপে ১০০/৫০০/১০০০ লেখা আছে এবং জলছাপের বামপাশে বাংলাদেশ ব্যাংকের উজ্জ্বলতর ইলেকট্রোটাইপ জলছাপ রয়েছে। ১০০/৫০০/১০০০ টাকার নোটের সামনের দিকে পটভূমি বা ব্যাকগ্রাউন্ডে হালকা অফসেটে জাতীয় স্মৃতিসৌধ রয়েছে। ১০০০ টাকার নোটের পেছনের দিকে ইন্টাগ্লিও কালিতে জাতীয় সংসদ ভবন মুদ্রিত আছে যা হাতের আঙুলের স্পর্শে অসমতল অনুভূত হবে।
৫০০ টাকার নোটের পেছনের দিকে ইন্টাগ্লিও কালিতে বাংলাদেশের কৃষিকাজের দৃশ্য মুদ্রিত আছে যা হাতের আঙুলের স্পর্শে অসমতল অনুভূত হবে। ১০০ টাকার নোটের পেছনের দিকে ইন্টাগ্লিও কালিতে ঢাকার তারা মসজিদ মুদ্রিত আছে যা হাতের আঙুলের স্পর্শে অসমতল অনুভূত হবে। ১০০/১০০০ টাকার ডানদিকের কোণায় ১০০/১০০০ লেখাটি সরাসরি তাকালে সোনালী এবং তীর্যকভাবে তাকালে সবুজ রং দেখা যাবে। ৫০০ টাকার ডানদিকের কোণায় সরাসরি তাকালে ৫০০ লেখাটি লালচে এবং তীর্যকভাবে তাকালে সবুজ রং দেখা যাবে।
Advertisement
‘সহজেই জাল টাকা শনাক্ত করবেন যেভাবে’ বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে কিছু সহজ উপায় উল্লেখ করা হয়েছিল। জাল টাকার টাকার নোটগুলো নতুন হবে কারণ জাল টাকার নোটগুলো সাধারণ কাগজের তৈরি; তাই পুরাতন হয়ে গেলে সেই নোট নাজেহাল হয়ে যায় বা তা অতিসহজেই বোঝা যায়। জাল টাকার নোট ঝাপসা দেখায়। আসল নোটের মতো ঝকঝকে থাকে না।
জাল নোট হাতের মধ্যে নিয়ে মুষ্ঠিবদ্ধ করে কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিলে তা সাধারণ কাগজের মতো ভাঁজ হয়ে যাবে। আর আসল নোট ভাঁজ হবে না। যদিও সামান্য ভাঁজ হবে তবুও তা জাল নোটের ক্ষেত্রে তুলনামূলক অনেক বেশি। টাকা সবসময় দুটি অংশ দিয়ে তৈরি হয়। টাকার দুই পার্শে দুটো নোট জোড়া লাগানো থাকে এবং এটা হরিণের চামড়া দিয়ে তৈরি বলে পানিতে ভেজালেও খুব তাড়াতাড়ি ভেঙে যাবে না। আর জাল নোট পানিতে ভেজানোর সাথে সাথেই তা ভেঙে যাবে। আসল নোট সবসময় খসখসে হবে।
নোট জাল করা ও জাল নোট লেনদেন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে জালনোট কারবারির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে আইন সংশোধন করে জাল নোটের সঙ্গে জড়িতদের মৃত্যুদণ্ড বা ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড দেয়ার বিধান রাখা হয়। আমাদের প্রত্যেকের আসল নোটের বৈশিষ্ট্যসমূহ জানা উচিত। কারণ জাল টাকা চিনতে না পারলে, ক্ষতি কিন্তু আমাদেরই হবে, অন্য কারও হবে না।
লেখক : অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
এইচআর/এমএস