সাহিত্য

সানাউল্লাহ সাগরের পাঁচটি কবিতা

বিষ-টি’র কাটপিস

Advertisement

না হও—তবু হয়ে আছো। ফেলে গেছো যাতায়াত।

‘হ্যাঁ’ বলতেই নেলপালিশ জ্বলে ওঠে। ইচ্ছেডাঙায় নেমে আসে সঙ-সারের ফটোশ্যুট। আরও অপরাপর যেসব চোখহীন কথারা এখনো ছুঁতে শেখেনি প্রতিবেশীর পা। তারাও অন্যান্য পবিত্রতায় শোক ছড়িয়ে রাধা-কৃষ্ণ হয়ে ওঠে! তারপর ডানে-বামে বেয়ে ওঠে নিষিদ্ধ।

‘না’ বলতেই মিথ্যা হয়ে যাচ্ছি। ভূগোলে কাঁদছে বৈরী-উষ্ণতা; ওখানে যদি কেউ থাকে—সেও তুমি! বৃত্তান্ত পটিয়ে প্রতিটি মহাদেশের সিঁথিতে পাঠালেও ফিরে আসো তুমি। আর তুমি বাদ দিয়ে শুরু হলে পথ—ছক্কায় গ্যালারি বলে দেয় এই বলে বোল্ড হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী।

Advertisement

শৈশবে হেগেল আসতো। প্রথম আঠেরোতে রাধার আংশিক। পুরো সিনেমার জন্য চোখ বিক্রির হাট বসিয়ে—হ্যাঁ-না’র কসরত দেখতাম। শাদা চুলে চোখ ফিরে শেষ দমে ঠোঁটেই নেমে যেত।

শুক্রবার এলে বর্গা চাষির কথা মনে পড়ে—শাহবাগ, টিএসসিতে তোমার গন্ধ পাই না। মনে হয় রাধার চশমায় কেউ কাঁদছে।

খুলছি। না তুমি, না পোশাক। খুলেই যাচ্ছি...

****

Advertisement

শীতের পাখি তোমাকে মনে পড়ে

তোমার চল্লিশ হয়ে যাচ্ছে। আমি ভাবছি বাইশ-তেইশ। বড় জোর ত্রিশ। চুলের গোড়ায় শাদা। চোখের ঘরে ঘুমের কুয়াশা। গলার আশপাশে লজ্জিত ব্রণ। তবু ভাবছি টোলপড়া গাল, সিঁথির দৈর্ঘ-প্রস্থ আর বেশুমার পাখি। বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাতে চশমাও এখন; ঠোঁটে প্রচণ্ড শীত। কত্তো ফড়িং এখনো হাতে হাতে...

তোমার ছুটি কমে যাচ্ছে। বুকের ঢেউও গতিভূক। তলে পেটে জমে উঠছে নগর। হাঁটার ভঙ্গিতে যেসব পরিবর্তন এসেছে সেসব মুখস্থ বলছি না আর—

যা যাচ্ছে অথবা আসছে তাদের কোনটাই নেই তুমি! তুমি ছিলে গ্রাফ-বৃত্তের পাশে, মুদিহাতের বিন্যাসে, কাঁপানো জ্বরে! তোমার সাঁকোতে গলুই ফলেছে, ধর্মে জ্বলেছে কার্ফু। পায়ে নেচেছে ধুলোর কাকুই আর হাতে মৃত্যুর ফণা।

তোমার পাঠ ঘনাচ্ছে। মিঠে হচ্ছে শোকপিন—

ত্রিশের পর মেয়েরা নারী হয়ে ওঠে। আর চল্লিশের পর তরুণেরা পুরুষ। তুমি কি এখন মা হয়ে উঠবে! আমি তো ইদানীং তোমার চাঁদে দ্বৈত নিশ্বাস টের পাই। সেখানে কোনটা শৈশবের আর কোনটা ত্রিশের ঠিক করতে পারি না।

****

বৃষ্টি ও হরিণীর গল্প

প্রকৃত সত্য হচ্ছে—বৃক্ষ শাদা হলে মানুষ তার যৌবন হারায়! ঘটে যাওয়া সব সত্যদের কান এই অকৃজ্ঞ প্রেমপত্রের যৌক্তিকতা খুঁজছিল। কখনো শ্রাবণে, আবার কখনো হরিণীর লজ্জিত তিলে। প্রকাশ্য যে তিলটি বেশি কথা বলে তার থেকে—ছুঁই ছুঁই দূরত্বে ছিল আমার ইস্টিশন।

তখন কুয়াশা; ফুলে-ফলে নিকানো অগ্রহায়ণ—আদর্শ দেয়ালে স্থির খরচের টালি। অথই বৃষ্টিতে হরিণী আবার; কপাটে কপাট—কুয়োতে ডাকছে হাবিলের বোন। সেই ভাষায় হরিণী ও জমানো বৃষ্টি আমার ভ্রুতে ছড়িয়ে গেল। তখন আমার গৌরবে কবুল শব্দের বিকল্প কোনো অস্থিরতা ছিল না।

তখন আষাঢ়; পবিত্র কানকে নিয়ে আমার ঘোর গবেষণা—অন্যত্র হিমায়িত অভিমান। হরিণীর চোখ বেয়ে কি এক তীব্রতা তখনো, বৃষ্টি—অভাবে ছড়াচ্ছিলো আয়ু। বেঁচে যাচ্ছি ভেবে, এলোমেলো হয়ে গেলাম আরও...

এখন শ্রাবণ; প্রহরা ছাড়া আমার আর কোনো আভিজাত্য নেই। সরল সীমায় লেজকাটা কুকুরের মতোন জানালার ওপাশে—রেইনট্রির চোখ অনবরত মেপে যাচ্ছিলো; জলগামী তৃষ্ণার গতি। হাত কাঁদছে। তুমি বলছো—এখানে নয়; আরও গতিশীল হও। আরও গঠিত হও গ্রীষ্মের মতোন। আমি পালতোলা নৌকায় সমস্ত পৈত্রিক বোঝাই করে দিলাম। বৃষ্টিহীন—সেই নৌকা শালিক হয়ে গেল। তুমি তার নাম দিলে শার্লি। আর বিচ্যুত স্বপ্নের পাহারা ভেঙে পদ্যের নিকোটিন বুক ঘেঁষে ঠোঁটে ডুবে গেল। জ্বরের করুণ বিষ—ফুঁপিয়ে স্থির হল পিঠের খৈলান বেয়ে ঢোলের মসৃণে। নাকের শোক আবার ঢেউয়ে—সরিষার খোঁপায়। তখন আবার মনে হল—প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বৃষ্টি একটি যাত্রা বিরতির নাম।

সামনে ভাদ্র; হরিণীর গ্রামে কোনো কবিতা নেই। ফলাফলে লিখিত হচ্ছে—বৃষ্টি ও হরিণীর গল্প।

****

তুমি কেনো ওমন করে হাসো

তোমার স্পর্শ জমা করার সময় ভাবতাম—এগুলো জমা হতে হতে একাধিক পাহাড় হয়ে যাবে। সেখানে ঘাসের নাকে-মুখে লেপ্টে থাকবে রাজধানীর হতাশা—মিঠে যন্ত্রণার প্রতিবাদ। জমা হচ্ছিলো তারাও—ঘৃণা এবং নিঃসঙ্গ অলংকার; যে সুতোয় তোমার হাত লেগে জ্বলে উঠেছিল বিশ্বাস! জমা করা স্পর্শ থেকে খানিক প্রজাপতি মুক্ত হলো সমুদ্রের ঢেউয়ে। সেখানে তোমার চোখ, ঠোঁটের তাশাহুদ লাফিয়ে উঠছিলো বালুর নূপুরে।

তারপর শূন্য পৃষ্ঠায় কতো নাম—কতো নিরাবরণ বানান থেকে খসে গেলো জমাকৃত ঈশ্বরেরা। তাদের ঠিকানা হলো দূরত্বের সিঁড়িতে। উঠছো আবার—নেমে যাচ্ছো; দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপিত হচ্ছো খুব। অথচ তোমারো ছিল ভূগোল বর্জিত সবুজ শস্য—ফিরে আসা নাবিকের আমন ক্ষেতে তোমার চুল উড়ে যেত—আরও একাকিত্বের খোঁজে।

তুমি বালিহাঁসের খোঁপায় নাবালক হও—নিংড়ে ক্ষমা নাও বাঁশির। ধাপে ধাপে উঠে যাচ্ছো; দাঁতের দরজায় খিল এঁটে—তুমি কেনো ওমন করে হাসো?

****

বরষার চশমা

শেষ বিকেলের সরু আলো চলে গিয়ে কালো হাসি চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই হিম বরষার রাত—এক কাপ কফি—নিঃসঙ্গ হাতফোন আর একটু দূরে চিকিৎসা বালিকার নির্দেশিত পাওয়ারী চশমা, ভাবছি কোনটা আমার আপন! এক্কেবারে দূরের ওই যে চোখটা ওটা রবিবাবুর... এই হাহাকারের বেলায় সে এখানে কী করছে? তার জন্য একটু জানালা গলিয়ে মাঠের পাশে শিরিষ গাছের স্নানও দেখা যায় না; কতো দিন পর বৃষ্টির সাথে এভাবে দেখা। পাশে জানালার কান থেকে ঘাসের জীবন, অশান্ত স্রোতের আখ্যান—এইসব ভুলে রবিবাবুর চোখ জানালাটা ছাড়ছে না।

আহা রবীন্দ্রনাথ—এই অন্ধকারে তোমার সফেদ দাড়ি আমার মধ্যে বৃষ্টির ঢেউ শানিয়ে দিচ্ছে। আরও অন্ধকার—আরও বিরক্তির ছায়া তাড়িয়ে আমাকে কেতকীর চেয়ার বরাবর দাঁড় করিয়ে রেখেছে। অবশেষে সব গালাগালে চোখ ডুবিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে ঝরছে মেঘের স্রাব; টিপটিপ নামছে রবীন্দ্রনাথের নায়িকারা...

এসইউ/এমএস