বিশেষ প্রতিবেদন

স্বরূপে বহুজাতিক, উল্টোপথে কেবল বাটা

ভালো মুনাফার পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের নিয়মিত লভ্যাংশ দেয়ায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ বহুজাতিক কোম্পানি বরাবরই বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। বর্তমান ঊর্ধ্বমুখী বাজারেও সেই চিত্র দেখা যাচ্ছে। উল্টোপথে রয়েছে বাটা সু। প্রতিষ্ঠানটির প্রতি যেন বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ কিছুটা হারিয়ে ফেলেছেন। যে কারণে চলতি বছরের প্রথম মাসে (জানুয়ারি) তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ার দাম বাড়লেও কমেছে বাটা সু’র দাম।

Advertisement

মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে গত বছরের মার্চের শেষ দিকে ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। জনজীবনে নেমে আসে এক ধরনের স্থবিরতা । যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাটার ব্যবসায়। এতে ২০২০ সালের এপ্রিল-জুন সময়ে প্রথমবারের মতো লোকসানের খাতায় নাম লেখায় কোম্পানিটি। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি লোকসান করে ৫৩ টাকা ৭৪ পয়সা। সেপ্টেম্বর শেষে সেই লোকসান বেড়ে হয়েছে ৮৯ টাকা ২৩ পয়সা।

বড় এই লোকসানের প্রভাব পড়েছে কোম্পানিটির শেয়ার দামেও। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৭৮২ টাকায় লেনদেন হওয়া প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দাম বর্তমানে (২৮ জানুয়ারি) ৭০২ টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা গত ২০ আগস্টের পর সর্বোচ্চ। অবশ্য ২৭ জানুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ার দাম ৬৯৫ টাকা ছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেঁধে দেয়া নিয়ম অনুযায়ী (ফ্লোর প্রাইস) কোম্পানিটির শেয়ার দাম ৬৯৩ টাকা ২০ পয়সার নিচে নামার সুযোগ নেই। অর্থাৎ কোম্পানিটির শেয়ার দাম ফ্লোর প্রাইসের আশপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে।

এদিকে ফ্লোর প্রাইসের কারণে কোম্পানিটির শেয়ার বড় দরপতনের হাত থেকে রক্ষা পেলেও চলতি বছরের প্রথম মাসে দাম কিছুটা কমেছে। এক মাসের ব্যবধানে প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে ৩ পয়সা। এতে সম্মিলিতভাবে শেয়ার দাম কমেছে ৪১ লাখ ৪ হাজার টাকা।

Advertisement

এপ্রিল-জুন এবং জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে লোকসানের বিষয়ে বাটা কর্তৃপক্ষ জানায়, কোভিড-১৯ এর কারণে সীমিত বিক্রি হওয়ায় এমন লোকসান হয়েছে। সাধারণত ব্যবসার ২৫ শতাংশ আসে ঈদের কেনাকাটা থেকে। কিন্তু করোনার কারণে এ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় মাত্র ১৫ শতাংশ বিক্রি হয়েছে।

এখন ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলে দাবি করেন বাটার দায়িত্বশীলরা। এ বিষয়ে বাটার কোম্পানি সচিব হাশিম রেজা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের বিক্রি পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।’

এদিকে বাটার শেয়ার দাম কমলেও গত এক মাসে তালিকাভুক্ত বাকি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ার দাম বেড়েছে। এতে চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ার দাম সম্মিলিতভাবে বেড়েছে ১৩ হাজার ৩৯৬ কোটি ৭৬ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো শেয়ারের দাম। এক মাসে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম বেড়েছে ৪২১ টাকা ৭০ পয়সা। এতে সম্মিলিতভাবে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়েছে সাত হাজার ৫৯০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এই দাম বাড়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার পুঁজিবাজারের সবচেয়ে দামি তালিকার চতুর্থ স্থানে রয়েছে।

Advertisement

সম্মিলিতভাবে শেয়ার দাম সর্বোচ্চ বাড়ার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে গ্রামীণফোন। জানুয়ারি মাসে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়েছে চার হাজার ৩৭ কোটি ৩৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা। প্রতিটি শেয়ারের দাম বেড়েছে ২৯ টাকা ৯০ পয়সা।

সম্মিলিতভাবে শেয়ার দাম ৬৫০ কোটি ৩৬ লাখ ৯১ হাজার টাকা বাড়ার মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে লাফার্জহোলসিম। জানুয়ারি মাসে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম বেড়েছে পাঁচ টাকা ৬০ পয়সা। শেয়ার দাম ৬১৩ কোটি ১১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা বাড়ার মাধ্যমে পরের স্থানে রয়েছে বার্জার পেইন্টস। জানুয়ারি মাসে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ার দাম বেড়েছে ১৩২ টাকা ২০ পয়সা। পুঁজিবাজারের সর্বোচ্চ দামি শেয়ারের তালিকায় এ কোম্পানির স্থান পঞ্চম।

ডেটল, মরটিন, হারপিক, ভ্যানিশ, লাইজল ও ভিটসহ কয়েকটি প্রসাধনী পণ্যের কল্যাণে বাংলাদেশে বছরের পর বছর দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করা রেকিট বেনকিজারের প্রতিটি শেয়ার দাম জানুয়ারি মাসে বেড়েছে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা। এতে সম্মিলিতভাবে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়েছে ৪০ কোটি ৯৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। প্রতিটি শেয়ারের দাম বেড়ে হয়েছে চার হাজার ১৩৩ টাকা ৫০ পয়সা। এতে পুঁজিবাজারের সবচেয়ে দামি শেয়ার হিসেবে কোম্পানিটির স্থান পোক্ত হয়েছে।

সবচেয়ে দামি শেয়ারের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইউনিলিভার কনজ্যুমার কেয়ারের (সাবেক গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন) সঙ্গে কোম্পানিটি শেয়ার দামের ব্যবধান বর্তমানে হাজার টাকার ওপর। অবশ্য জানুয়ারি মাসে ইউনিলিভার কনজ্যুমার কেয়ারের শেয়ার দামেও বড় উত্থান হয়েছে। এক মাসে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ২৩১ টাকা ৪০ পয়সা বেড়ে তিন হাজার ৪০ টাকা ৬০ পয়সায় উঠেছে। এতে সম্মিলিতভাবে এক মাসে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়েছে ২৭৮ কোটি ৭৫ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।

এছাড়া সম্মিলিতভাবে শেয়ার দাম লিন্ডে বাংলাদেশের চার কোটি ২৬ লাখ ১১ হাজার টাকা, হাইডেলবার্গ সিমেন্টের ৭৬ কোটি ২৭ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, আরএকে সিরামিকসের ৯৮ কোটি ৪৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা, ম্যারিকো বাংলাদেশের ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা এবং সিঙ্গার বাংলাদেশের ৬৯ লাখ ৭৯ হাজার টাকা বেড়েছে।

গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন থেকে নাম বদলে ‘ইউনিলিভার কনজ্যুমার কেয়ার’ হলেও কোম্পানিটির পণ্য ও মানের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হবে না বলে জানান কোম্পানির হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স শামীমা আক্তার।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইউনিলিভার গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন কিনে নিলেও পণ্য ও পণ্যের মানের কোনো পরিবর্তন হবে না। গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করেছে। হরলিকসসহ সব পণ্যই পাওয়া যাবে। তবে মার্কেটিংয়ের পলিসির ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন হবে। ইউনিলিভারের মার্কেটিং পলিসি অত্যন্ত শক্তিশালী। সুতরাং এখন এসব পণ্য মার্কেটিংয়ের গ্রোথ বাড়বে।’

জাগো নিউজের পক্ষ থেকে রেকিট বেনকিজারের কোম্পানি সচিব নাজমুল আরিফিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যবসার পলিসি নিয়ে মিডিয়ার সঙ্গে কোনো কথা বলি না।’

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মো. রকিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন খুবই স্বচ্ছ। তারা কোনো তথ্য ম্যানুপুলেট করে না। তাদের ব্যবসার প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিক। নিয়মিত ভালো মুনাফার পাশাপাশি শেয়ারহোল্ডারদের বড় লভ্যাংশ দেয়। এদের আর্থিক ভিত্তি খুবই শক্তিশালী। যে কারণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে। আমাদের দেশি কোম্পানিগুলোর ৮০ শতাংশ যদি তাদের মতো স্বচ্ছ হতো, তাহলে পুঁজিবাজারের চেহারা পরিবর্তন হয়ে যেত।’

এমএএস/ইএ/এইচএ/জেআইএম