তথ্যমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত বললেন সাংবাদিকতার ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণের বিষয়টি সরকার খতিয়ে দেখছে। এতদিন শুনে আসছিলাম সরকার এই ইস্যু নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায় না। তথ্যমন্ত্রীও বারবার এ বিষয়ে নীরব থেকেছেন। বোধকরি রোববারই প্রথম জাতীয় সংসদে তথ্যমন্ত্রী জানালেন প্রচলিত কোনো আইন বা নীতিমালায় সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতার কোনো মানদণ্ড নেই। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল আইন-১৯৭৪ সংশোধন করে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিনা তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।সাংবাদিক হতে হলে যে একটু পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণের দরকার আছে সেটা সবাই স্বীকার করলেও শিক্ষাগত যোগ্যতা বাধ্যতামূলক করার কথা বললে অনেক সাংবাদিকই ক্ষেপে যান। তাই প্রকাশ্যে এ নিয়ে কেউ কথা বলেন না। কারণ সাংবাদিকদের ক্ষেপাতে চায় না কেউ। এবার যখন তথ্যমন্ত্রী বলেই ফেলেছেন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতার বিষয়টি নিয়ে সরকার ভাবছে, তখন সরকারকে বলব, এখন এটি বাস্তবায়ন করা হোক। আমরা তথ্যমন্ত্রীর ওই বক্তব্য যে নিছক কথার কথা নয় সেটা দেখতে চাই। দুনিয়ায় এমন কোনো পেশা নেই যেখানে শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের দরকার হয় না। বাংলাদেশেই শুধু সাংবাদিকতা করতে হলে কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা বা প্রশিক্ষণ লাগে না। এদেশে কবিরাজী করতে হলেও তাকে কিছু কৌশল রপ্ত করতে হয়। আর সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে যেন সাতখুন মাফ। সাংবাদিকদের সবচে বড় পদ হল সম্পাদক। এই পদটি রীতিমত ধর্ষিত। বলা নেই কওয়া নেই, ক লিখতে কলম ভাঙ্গে এমন অনেকেই সম্পাদক বনে গেছেন। তারা সম্পাদক হলেনই বা কী করে, কে তাদের অনুমোদন দিল, এসব নিয়ে আর আলোচনাই হয় না। সম্পাদকদের অনেকেই সম্পাদনা করেন না। তারা টাকার জোরে পত্রিকা প্রকাশ করেন আর আইনের অভাবে তারা নিজেরাই সম্পাদক হয়ে যান। জীবনে একদিনের জন্যও সাংবাদিকতা করেননি কিন্তু সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়েছেন ১৫ বছর সাংবাদিকতা করেছেন- এমন সম্পাদকের অভাব নেই এই দেশে। যেখানে সম্পাদকদেরই কোনো যোগ্যতা লাগে না সেখানে তার অধীনে সাংবাদিকদের যোগ্যতা নির্ধারণ করা হাস্যকরই হবে বটে। তথ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই এবার সম্পাদক হতে হলেও কমপক্ষে কী কী যোগ্যতা লাগবে সেটিও নির্ধারণের চেষ্টা করবেন। আর সেই যোগ্যতা কী রকম হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা জরুরি। বিষয়টি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো সন্দেহ নেই। তাই আলোচনা হওয়া উচিত। তথ্যমন্ত্রী সেই আলোচনার দুয়ার খুলে দিয়েছেন। সাংবাদিকদের শত সংগঠনের মধ্যে প্রেসক্লাব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ, নিউজপেপার ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, সম্পাদক পরিষদ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলদেশ- পিআইবি, প্রেস কাউন্সিল, গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট- এরকম যত প্রতিষ্ঠান রয়েছে সবখানেই এই আলোচনা দরকার। কারণ সাংবাদিকতার মান দিনকে দিন যে নিম্নগামী সেটা আর গবেষণা করে বের করার দরকার নেই, আমার ২৬ বছরের অভিজ্ঞতা থেকেই এটা বলতে পারি যে এই পেশাটি নীতি নৈতিকতা আর দক্ষতার মাপকাঠিতে অনেকটাই নিচে নেমে গেছে। আমরা জানি সাংবাদিকদের যোগ্যতা নিয়ে যাচাই বাছাই শুরু হলে অনেকেই নাখোশ হবেন, এক সময় আমিও ভাবতাম শিক্ষাগত যোগ্যতা সাংবাদিকতার জন্য বাধ্যবাধকতা হতে পারে না, কিন্তু আজ সাংবাদিকতা এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে সেখানে ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ আমরা সাংবাদিকরা এই পেশাটির মান মর্যাদা ধরে রাখতে পারছি না। আমাদের মধ্যে প্রচুর অর্ধশিক্ষিত, ক্ষেত্রবিশেষ মূর্খসহ নানা ধান্দাবাজ ঢুকে পড়েছে। তাদের কারণেই সাংবাদিকতার নামে আজ অপসাংবাদিকতা বেড়েছে, দায়িত্বশীলতা কমেছে। রাস্তায় বের হলেই দেখা যায় সাংবাদিকদের ছড়াছড়ি। পঞ্চম শ্রেণির গণ্ডি পার হতে পারেনি কিন্তু সাংবাদিকতার পরিচয়পত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে শতশত টাউট বাটপার। এসব আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার পাশাপাশি ঘরে বসে অনলাইন পোর্টাল খুলে নানা জায়গা থেকে নিউজ কপি পেস্ট করেও শতশত সাংবাদিক নামধারীর জন্ম হয়েছে। পানের দোকানদার, চায়ের দোকানিও এখন সাংবাদিক পরিচয় দিচ্ছে। ফেসবুকিং করে এমন অনেকেই নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মোটরসাইকেলের সামনে প্রেস লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের হাত থেকে সাংবাদিকতাকে বাঁচাতে হলে অবশ্যই যোগ্যতার বিষয়টি ভাবতে হবে। সাংবাদিকদের সব সংগঠনের উচিত এ বিষয়ে তথ্যমন্ত্রীকে সব রকমের সহায়তা করা। সাংবাদিকতার মানোন্নয়ন ও পেশার সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতেই এটা করতে হবে নয়তো নকল সাংবাদিকদের ভিড়ে আসল সাংবাদিকদের হারিয়ে যেতে বেশিদিন আর লাগবে না। এইচআর/এমএস
Advertisement