‘কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটা, সজনে ডাঁটায় ভরে গেছে গাছটা, আর আমি ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি। খোকা, তুই কবে আসবি? কবে ছুটি? চিঠিটা তার পকেটে ছিল, ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা। মাগো ওরা বলে সবার কথা কেড়ে নেবে। তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না। বলো, মা তাই কি হয়?’
Advertisement
না, তা হয়নি। ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদী কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতার মতোই হারিয়ে যায়নি মায়ের ভাষা, মায়ের কোলে শুয়ে গল্প শোনার মধুময় স্মৃতি। সেজন্যই হয়তো সুদীর্ঘ সময়ের পথ ধরে ভাষা, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি লালন করে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, এগিয়ে যাচ্ছে প্রজন্ম।
এগিয়ে চলা এ প্রজন্মের তেমনই এক ক্ষুদে বাঙালির সন্ধান মিলেছে রংপুর নগরীতে। বয়স মাত্র চার বছর। স্কুলের বারান্দায় পা রাখা হয়নি এখনও। এরই মধ্যে দেশবরেণ্য কবি-সাহিত্যিকদের শতাধিক কবিতা, ছড়া ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ মুখস্থ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে ছোট্ট জান্নাতুল মাওয়া।
কবিতার মতোই ছবি আঁকা আর কারাতে প্রশিক্ষণে যেমন মুন্সিয়ানা দেখিয়েছে তেমনি পবিত্র কোরআন শরিফের সুরা ও আয়াতুল কুরসি মুখস্থ করেও ফুটিয়ে তুলেছে তার অভাবনীয় প্রতিভা। রংপুর ক্যান্ট. পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক (বাংলা) মা মনিরা আক্তারের উৎসাহ আর একান্ত প্রচেষ্টায় ক্ষুদে জান্নাতুল মাওয়ার এমন প্রতিভায় বিস্মিত অনেকেই।
Advertisement
জান্নাতুল মাওয়ার জন্ম ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর। রংপুর নগরীর কটকিপাড়ায় তাদের বসবাস।
দেড় বছর আগে রংপুরে ‘কিশোর আলো’ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীর পুরুষ’ কবিতা আবৃতি করে দর্শক মাতানো এই ক্ষুদে মাওয়ার নখদর্পণে এখন শামসুর রাহমানের স্বাধীনতা তুমি, কাজী নজরুল ইসলামের মানুষ, লিচু চোর, নারী, মিথ্যাবাদী, খুকী, কাঠবিড়ালি, রবীন্দ্রনাথের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, প্রশ্ন, সোনার তরী, ছুটি, সৈয়দ শামসুল হকের আমার পরিচয়, নির্মলেন্দু গুণের স্বাধীনতা এ শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো, আমি কারও রক্ত চাইতে আসিনি, পূর্ণেন্দু পত্রীর সেই গল্পটা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কেউ কথা রাখেনি, সুকান্তের ছাড়পত্র, সুকুমার রায়ের বিষম চিন্তা, ভুতুড়ে খেলা, ভয় পেও না, ভালো রে ভালো, আবল তাবল, গোঁফ চুরি, জীবনের হিসাব, সৎপাত্র, আবু হেনা মোস্তফা কামালের ছবি, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কোনো এক মাকে, অন্নদাশঙ্কর রায়ের নেমন্তন্ন, কালীপ্রসন্ন ঘোষের কাজলা দিদি, সুফিয়া কামালের মুজিব মৃত্যুঞ্জয়ী, আনিসুল হকের ৩২ নম্বর মেঘের ওপারে বাড়ি, হাসান মনিরের রাসেল কান্না শুনতে পায়, তপন বাগচীর জন্মদিনের শুভেচ্ছাসহ দেশবরেণ্য ৩০-৩৫ জন কবি-সাহিত্যিক ও ছড়াকারের শতাধিক কবিতা এবং ছড়া।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণও না দেখে বলতে পারে এই বিস্ময় বালিকা।
এর বাইরে আরবিতেও তার দক্ষতা ফুটে উঠছে। পবিত্র কোরআন শরিফের ছোট ১০টি সুরাসহ আয়াতুল কুরসি মুখস্থ তার।
Advertisement
এছাড়া ছবি আঁকায়ও বেশ পারদর্শী সে। কারাত প্রশিক্ষণে ইতোমধ্যে হলুদ বেল্ট অর্জনে সক্ষম হয়েছে মাওয়া।
‘চলো স্বপ্ন ছুঁই’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনের কনিষ্ঠ এ সদস্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ছাড়াও সাহিত্য পরিষদসহ ক্যান্ট. পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিভিন্ন জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে কবিতা আবৃত্তি করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।
গত জন্মদিনটাও কাটিয়েছে পথশিশুদের নিয়ে। কেক কাটার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল অর্ধশত পথশিশু।
বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বুকে ধারণ করে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক হয়ে বেড়ে উঠবে মাওয়া- এমনটাই প্রত্যাশা তার স্বপ্ন পূরণের সারথী মা মনিরা আক্তার।
মনিরা আক্তার বলেন, কথা বলতে শেখার পর থেকেই মাওয়ার স্মৃতিশক্তির প্রখরতা বুঝতে পারি। প্রথমে তাকে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে কিছু শেখাই।
আমার নিজেরও বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি একটা আলাদা ভালোলাগা এবং ভালোবাসা কাজ করে। আমাদের ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধ ঘিরে যে সাহিত্য-সংস্কৃতি গড়ে উঠৈছে তার প্রতিও মাওয়ার ভালোবাসা আছে। এসব নিয়ে তার জানার আগ্রহটা অনেক। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার একটা আলাদা টান কাজ করে।
জান্নাতুল মাওয়াতিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, আমার মেয়ে যে সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ভালোবেসে বাংলার ইতিহাস লালন করে এগিয়ে যাচ্ছে একদিন সে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক হয়ে উঠবে এবং দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করবে।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনানোর স্বপ্ন দেখে মাওয়া। প্রধানমন্ত্রী যদি তার ভাষণ শুনে তাকে অনুপ্রাণিত করেন তাহলে সে আরও বেশি এগিয়ে যাবে এ প্রত্যাশা মনিরা আক্তারের।
প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা আর সুযোগ পেলে সারাদেশের সম্পদ হয়ে গড়ে উঠবে মাওয়া, এমনটাই মনে করছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু।
তিনি বলেন, তার যে প্রতিভা, এজন্য তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা জরুরি বলে আমি মনে করি। কারণ, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণসহ দেশবরেণ্য কবি-সাহিত্যিকদের কবিতা ও ছড়া মুখস্থ করা এত ছোট বয়সে সহজ কাজ নয়।
তার কবিতা আবৃত্তির যে ভঙ্গিমা সেজন্য তাকে স্যালুট জানাই, তার প্রতিভাকে স্যালুট জানাই। রংপুরের জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সহযোগিতা পেলে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া হলে সে রংপুরের নয়, সারাদেশের সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত হবে বলে মনে করি।
মাওয়ার বয়স চার বছরের বেশি হলেও মেধার দিক থেকে সে বিস্ময়কর বলে মনে করেন কারমাইকেল কলেজের বাংলা বিভাগের ভূতপূর্ব অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহ আলম।
তিনি বলেন, আমাদের কাছে তো মনে হয় বিস্ময়কর বালিকা জান্নাতুল মাওয়া। তার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। যখন তার কাছ থেকে কবিতা আবৃত্তি শুনি, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনি তখন বিস্মিত হতে হয়।
নিজে এখনও যুক্তাক্ষর ঠিকমতো পড়তে পারে না, বানান করে করে কিছুটা পড়ে। তার মা মনিরা তাকে শেখান। মায়ের কাছ থেকে শুনে শুনে সে মুখস্থ করে।
শুধু কবিতা আবৃত্তি নয়, আবৃত্তির ক্ষেত্রে যে ভঙ্গি, যে আবেগ, মাত্রা বিন্যাসের যে গতি এবং কণ্ঠস্বরের যে উত্থান-পতন দরকার তার সবটাই সে দিতে চেষ্টা করে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বলার সময়ও সে বঙ্গবন্ধুর মতোই তাল মিলিয়ে বলার চেষ্টা করে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, জান্নাতুল মাওয়া রংপুরের গৌরব। ধীরে ধীরে সে আরও অনেক কিছু ধারণ করবে এবং আমাদের সংস্কৃতির যে বিকাশ সেই বিকাশে বলিষ্ঠ অবদান রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
এফএ/এমকেএইচ