নরসিংদীর মনোহরদীতে বখাটেদের হামলা ও শ্লীলতাহানির অপমান সইতে না পেরে অবশেষে মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছে আফরোজা আক্তার স্বপ্না নামের এক স্কুলছাত্রী। প্রেম প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় বখাটেরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সামনে শ্লীলতাহানির পর কুপিয়ে জখম করে স্বপ্নাকে। গত সোমবার রাতে মনোহরদী উপজেলা হাসপাতাল থেকে ঢাকায় নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।স্বপ্না উপজেলার নোয়াকান্দি হাজী আলিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। সে নোয়াকান্দি গ্রামের প্রবাসী আলীম উদ্দিনের মেয়ে। এদিকে ছাত্রী নিহতের ঘটনায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকের কোনো দায়িত্ব অবহেলা রয়েছে কীনা তা খতিয়ে দেখতে উপজেলা প্রশাসনকে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামান।এদিকে স্কুলছাত্রীর উপর হামলা ও শ্লীলতাহানির অভিযোগে তারাকান্দি গ্রামের রুহুল আমিনের ছেলে অভিযুক্ত বখাটে সজিবকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।অন্যদিকে স্কুলছাত্রীর নির্মম মৃত্যুতে স্কুলের সহপাঠি ও এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।পুলিশ ও নিহতের পরিবারের লোকজন জানায়, দীর্ঘ ২ বছর যাবৎ স্কুলছাত্রী আফরোজা আক্তার স্বপ্নাকে বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার পথে প্রেম প্রস্তাব দিয়ে আসছিল বখাটে সজিব। এতে সাড়া দেয়নি স্বপ্না। বিষয়টি স্বপ্না পরিবারের লোকজনকে জানালে তারা সামাজিকভাবে সজিবের পরিবারকে নালিশ জানায়। কিন্তু তার পরিবারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তারপরও স্বপ্নার পিছু ছাড়েনি সজিব। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে তাকে উত্যক্ত করত। কাজ না হওয়ায় নানানভাবে ভয় ভীতি দেখাতে শুরু করে সে। এতেও কাজ না হওয়ায় বখাটে সজিব স্বপ্নাকে দেখে নেয়ার হুমকি প্রদান করে। এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮ টার দিকে স্বপ্না নোয়াকান্দী হাজি আলিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিত শিক্ষক মো. সবুজ মিয়ার কাছে কোচিং করতে স্কুলে যায়। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান চলাকালে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বখাটে সজিব দুই সহযোগিকে নিয়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়। এসময় গণিত শিক্ষক সাইফুল ইসলাম সবুজ মিয়া ও অন্যান্য শিক্ষার্থীর সামনে স্বপ্নাকে ডেকে বারান্দায় নিয়ে আসে। এবং পুনরায় প্রেম নিবেদন করে। এতে রাজি না হওয়ায় এক পর্যায়ে বখাটে সজিব-স্বপ্নার স্কুলড্রেস ছিড়ে ফেলে। এক পর্যায়ে সজিব স্বপ্নার বাম উরু ও তল পেটে কুপিয়ে জখম করে। ওই সময় তার চিৎকারে সহকারী শিক্ষক সাইফুল ইসলাম সবুজ ছুটে আসলে সজিব পালিয়ে যায়। পরে শিক্ষক সবুজ উল্টো স্কুলছাত্রী স্বপ্নাকে ভৎর্সনা করেন। এতে রাগে ক্ষোভে বাড়ি ফিরে দুপুরে বিষপান করে স্বপ্না। আহত অবস্থায় আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে মনোহরদী উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে দীর্ঘ ৫দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে স্বপ্না। পরে তার অবস্থার অবনতি হলে গত সোমবার ঢাকা নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।স্বপ্নার মা নাজমা বেগম বলেন, তারা আমার মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে। আমি তাদের বিচার চাই। আমার মেয়ে যেহেতু পৃথিবী থেকে চলে গেছে সেও যেন পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। তার মুখ যেন আর আমাদের দেখতে না হয়।এই ঘটনায় গত শনিবার স্বপ্নার মা নাজমা বেগম বাদী হয়ে বখাটে সজিবের বিরুদ্ধে মনোহরদী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করে। পুলিশ এই মামলায় সজিবকে গ্রেফতারের পরই তার স্বজনরা নিহত ছাত্রীর পরিবারকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছে। স্বপ্না বড় বোন রত্না বেগম বলেন, তারা আমার ভাইকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। বোন হারিয়েছি এখন বিচার চাইতে গিয়ে আমার ভাইয়ের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে। তারা যেকোনো সময় আমাদের উপর হামলা চালাতে পারে।বিধি অনুযায়ী শিক্ষকদের বাণিজ্যিক কোচিং এর জন্য বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ ব্যবহারের জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন হয়। কিন্তু বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাইফুল ইসলাম সবুজ কর্তপক্ষের কোনো অনুমতি নেয়নি বলে জানিয়েছে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফজর আলী। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে স্কুলছাত্রীকে ভৎর্সনার অভিযোগ করেছে নিহত ছাত্রীর বড় ভাই নাজমুল হুদা। তিনি বলেন, ঘটনার পর আমার বোন সবুজ স্যারকে ঘটনাটি জানাতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি কোনো কথা শুনেনি, উল্টো তাকে গালমন্দ করে। ওনি কথা শুনলে আমার বোন আজ মারা যেত না।এই ব্যাপারে মনোহরদী থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন বলেন, নিহতের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নরসিংদী সদর হাসপাতালে মর্গে পাঠানো হয়েছে। এই ঘটনায় ইতোপূর্বে নিহতের মায়ের মামলার প্রেক্ষিতে অভিযুক্ত বখাটে সজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরবর্তীতে এই ঘটনার সঙ্গে কারা কীভাবে জড়িত, কাদের ইন্ধন আছে তা তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।ঘটনাটি দুঃখজনক উল্লেক করে জেলা প্রশাসক আবু হেনা মোরশেদ জামান বলেন, এই ঘটনায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকের কোনো দায়িত্ব অবহেলা রয়েছে কীনা তা খতিয়ে দেখতে উপজেলা প্রশাসনকে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সঞ্জিত সাহা/এমএএস/পিআর
Advertisement