আন্তর্জাতিক

চীনের ভ্যাকসিনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে

চিকিৎসা বিজ্ঞানে দেখা যায়, ব্যাপক সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মধ্যে যখন কোনো নতুন ওষুধ বা ভ্যাকসিনের পরীক্ষা করা হয়, তখন তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল এড়িয়ে গেলে ভাগ্য সেক্ষেত্রে খুব কমই প্রসন্ন হয়। কিন্তু গত বছর চীন থেকে করোনাভাইরাসের যে ভ্যাকসিনগুলো এসেছে সেগুলো ঠিক এভাবেই এসেছে।

Advertisement

বেইজিং বিমানবন্দরের কর্মীদের অপরীক্ষিত ভ্যাকসিন দেয়া হবে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। বছরের শেষ নাগাদ চীনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা নিশ্চিত করলেন, সেখানে জনগণের মধ্যে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়েছে। যদিও করোনাভাইরাসের জন্য দায়ী সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটির বিরুদ্ধে চীনে যে ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে তার তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল তখনো হয়নি। নভেম্বরের মধ্যে চীনের ১০ লাখ ব্যক্তিকে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। এত বিশাল ও অনিয়ন্ত্রিত পরীক্ষণ দেখে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা হতবাক হয়ে গেছেন।

এমন অস্বাভাবিকভাবে শুরু করার পরেও, চীনের তিনটি প্রতিষ্ঠান- সিনোফার্ম, সিনোভ্যাক ও ক্যানসিনো যথাযথ ট্রায়ালের মাধ্যমেই ভ্যাকসিন তৈরির কাজ সম্পন্ন করছে বলে মনে হচ্ছে। মান যাচাইয়ের জন্য বাহরাইন, ব্রাজিল, চিলি, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের ট্রায়াল পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনের যে ট্রায়ালগুলো হয়েছে, সেগুলোর সাম্প্রতিক ফলাফল সন্দেহ তৈরি করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্রাজিলের একটি ট্রায়ালে সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনের ৫০ শতাংশ অথবা যেভাবে তথ্য দেয়া হয়েছে তাতে ৭৮ শতাংশ কার্যকারিতা দেখা গেছে। এর আগে তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়ায় কার্যকারিতা দেখা গেছে যথাক্রমে ৯১ ও ৬৫ শতাংশ। এই হারকে সমর্থন করার মতো তথ্যের ঘাটতি রয়েছে।

তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়ায় কার্যকারিতার হারের এত তারতম্যের একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, ব্রাজিলের তুলনায় অনেক কম মানুষ এই ট্রায়ালে অংশ নিয়েছিল এবং সেখানে করোনা আক্রান্তের সংখ্যাও কম। এর ফলে কার্যকারিতার সঠিক হার নির্ণয়ে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের ট্রায়ালের প্রক্রিয়াতেও পার্থক্য রয়েছে- এটিও বোধহয় অসামঞ্জস্য তথ্যের আরেকটি কারণ।

Advertisement

এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ট্রায়াল হয়েছে ব্রাজিলে এবং সম্ভবত সবেচেয়ে ভালোভাবেও। এতে ১০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবী অংশ নিয়েছিলেন যারা ছিলেন স্বাস্থ্যকর্মী। সাও পাওলোর একটি সরকারি মেডিক্যাল স্কুলের অধ্যাপক মাউরিসিও নোগুয়েইরা ট্রায়ালের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ভাইরাসের কার্যকারিতায় ৫০ শতাংশ একটি রক্ষণশীল অনুমান।

এর প্রথম কারণ হল, সাধারণ ব্রাজিলিয়ানদের চেয়ে ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের পেশাগত কারণে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। দ্বিতীয় কারণ, আক্রান্তের লক্ষণের ব্যাপারে স্বাস্থ্যকর্মীরা সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি সচেতন। তৃতীয় কারণ, করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করা হবে কিনা সে ব্যাপারে সম্ভাব্য আক্রান্তের খুব সংবেদনশীল সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। আর এটা হল- অন্যান্য ট্রায়ালে আক্রান্তের তিনটি লক্ষণ দেখা দিলে পরীক্ষা করানো হয়েছে কিন্তু এই ট্রায়ালে পরীক্ষা করা হয়েছে একটি লক্ষণ দেখা দিলেই। ট্রায়াল পরিচালনাকারীরা বলছেন, এসব ‘অতি মৃদু’ সংক্রমণ বাদ দিয়ে যদি শুধুমাত্র ‘মৃদু’, ‘তীব্র’ ও ‘প্রাণঘাতী’ সংক্রমণকে বিবেচনা করা হয়, তাহলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা দাঁড়াবে ৭৮ শতাংশে।

তবে ব্রাজিলের চিকিৎসা নিয়ন্ত্রকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন হয়তো বিশ্বের সবচেয়ে সেরা ভ্যাকসিন নয়, কিন্তু এটি উপকারী। দেশটিতে এখন জরুরি অনুমোদনের আওতায় ভ্যাকসিনটির লাখ লাখ ডোজ প্রয়োগ করা হবে।

এরপরও…সারা বিশ্বের কথা বিবেচনা করলে, সিনোভ্যাকসহ চীনের অন্যান্য ভ্যাকসিন ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। যদিও ট্রায়ালে অসামঞ্জস্য ফলাফল, উৎপাদনে স্বচ্ছতার অভাব ও তথ্যের ঘাটতির কারণে এগুলো নিয়ে সন্দেহও চলতে থাকবে। খবরে এসেছে, পশ্চিমা ভ্যাকসিনকে প্রতিযোগিতায় পেছনে ফেলতে চীনা বিশেষজ্ঞদের যে আকাঙ্ক্ষা, সেক্ষেত্রে দেশে তৈরি ভ্যাকসিনের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দিয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন নিয়ে ইতোমধ্যেই আস্থাহীনতা লক্ষ্য করা গেছে। তবে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনে সিনোফার্ম ভ্যাকসিন বেশ ভালোভাবে গৃহীত হয়েছে।

Advertisement

বিশ্বে চীনা ভ্যাকসিনের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে ট্রায়াল ও উৎপাদনের তথ্য আরও স্বাধীনভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। ওয়াশিংটন ডিসির জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির ও’নিল ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল অ্যান্ড গ্লোবাল হেলথের প্রধান লরেন্স গস্টিন বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মূল্যায়ন শেষে তা অনুমোদন পেলে চীনা ভ্যাকসিন বিশ্ব জুড়ে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারবে।

সিনোভ্যাক ও সিনোফার্মের ভ্যাকসিন উৎপাদনে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করা হচ্ছে কি-না তা যাচাই করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা এখন চীনে রয়েছেন। এরপর তারা মান, নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করবেন। সূচনাটা ঠিকঠাকভাবে না হলেও, এই ভ্যাকসিনগুলোর যোগ্যতা প্রমাণের সম্ভাবনা এখনো রয়েছে।

সূত্র : দ্য ইকোনমিস্ট

এমকে/জিকেএস