বিশেষ প্রতিবেদন

‘ক্ষমতা থেকে অপরাধকে আলাদা না করলে নির্যাতন হবেই’

ডা. ফওজিয়া মোসলেম। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে একজন সংগঠক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধসহ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই-সংগ্রামে যুক্ত রয়েছেন। বর্তমানে তিনি মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

Advertisement

সাম্প্রতিক সময়ে নারী-শিশু নির্যাতন, আইন সংশোধন করে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান, নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানবিক রাষ্ট্র গঠন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কার্যক্রম প্রসঙ্গে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক আলী ইউনুস হৃদয়।

জাগো নিউজ: নতুন বছরে আপনি কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?

ফওজিয়া মোসলেম: নতুন বছরে আমাদের সবার একটাই আকাঙ্ক্ষা— করোনাভাইরাসমুক্ত কিংবা করোনা নিয়ন্ত্রণ হয়েছে, এমন একটি সুন্দর বাংলাদেশ। পাশাপাশি দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান অধিকার ভোগ করবে- এটাই প্রত্যাশা।

Advertisement

নারী নির্যাতনের পেছনে ক্ষমতার দাপটকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী করেন বিশেষজ্ঞরা

জাগো নিউজ: স্বাধীনতার ৫০ বছরে নারীর ক্ষমতায়ন কিংবা অধিকার কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে বা হওয়া দরকার বলে মনে করেন?

ফওজিয়া মোসলেম: আসলে আমাদের দাবি, নারী তার ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সমান অধিকার ভোগ করবে। সেক্ষেত্রে আমরা যদি দেখি, বাংলাদেশের ৫০ বছরে নারীর জীবনে উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু সেই উন্নয়ন হয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে। আজ নারী যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেখানে কিন্তু আবার নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসছে। কাজেই সবমিলিয়ে নারী যেসব চ্যালেঞ্জই মোকাবিলা-অতিক্রম করে গেছে, সেটা এখনো হয়নি। তবে বাইরে থেকে আমরা যেটা দেখি—নারীর জীবনে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে যে, নারী তার অধিকার নিয়ে বাঁচতে চায়।

জাগো নিউজ: নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণে বর্তমান সরকারের পদক্ষেপগুলোকে একজন সংগঠক হিসেবে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ফওজিয়া মোসলেম: সরকারের তো পদক্ষেপ আছেই, এর মাঝে বিশেষ করে আইন প্রণয়ন অন্যতম। এ আইনগুলোর কোনো কার্যকারিতা দেখছি না, সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এছাড়া রাষ্ট্রীয় কিছু নীতি আছে, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, যা নারীর অগ্রযাত্রার সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে অন্তরায় হয়ে আছে। এর পেছনে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের খুবই গভীরে ক্রিয়াশীল । সে জায়গা থেকে যদি মুক্ত না হওয়া যায়, তাহলে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপগুলোকে কাজে লাগানো যাবে না বা আমরা উপভোগ করতে পারবো না।

Advertisement

জাগো নিউজ: তথ্যপ্রযুক্তির এ সময়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের ধরন পরিবর্তিত হচ্ছে, এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

ফওজিয়া মোসলেম: তথ্যপ্রযুক্তি তো মানবসভ্যতার অন্যতম দিক। আমরা কেউই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের বাইরে থাকতে পারবো না। কিন্তু এটাকে আমরা কীভাবে নিজেদের ও সমাজের কল্যাণে ব্যবহার করবো, সেজন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নীতি থাকা দরকার। আমরা সম্প্রতি দেখলাম, কলাবাগানের স্কুলছাত্রীর ঘটনায় যা বের হয়ে এলো, তা আমাদের কাছে প্রথম অভিজ্ঞতা। এ করোনাকালে আমাদের ছেলে-মেয়েরা অনলাইনে পড়াশোনা করেছে, সময় কাটাচ্ছে। ইন্টারনেটে যে ধরনের পোস্টিং আসে, তা মানুষের মানসিক গঠনকে অনেকভাবে বিকৃত করে দিতে পারে। কাজেই তথ্যপ্রযুক্তির সে জায়গায় কড়া নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। পাশাপাশি স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যেন প্রযুক্তি মাধ্যম ব্যবহারে সবাই সচেতন হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম

জাগো নিউজ: কঠোর শাস্তিই কি এসব অপরাধ প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে?

ফওজিয়া মোসলেম: আইনের বিধান কখনোই অপরাধ কমাতে পারে না। সমাজের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত করার মধ্য দিয়ে অপরাধ কমাতে হবে। সেখানে যেটা আমরা দেখছি, ধর্ষণ কিংবা নির্যাতনের মতো যে ধরনের অপরাধ ঘটছে বা করোনাকালে বাড়লো, সেটার মূল কারণ হচ্ছে—নারীকে এখনো ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। কাজেই শুধু কড়া আইন নয়, বাস্তবে তো ছোট আইনের কোনো বাস্তবায়ন নেই। একটা ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের মামলার বিচার হতে হতে ১৫-১৬ বছর লেগে যায়। আবার সেখানে যদি ঘটনাটি কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি দ্বারা সংঘটিত হয়, তাহলে ১৫-১৬ বছরেও বিচার হয় না। তাই এখানে যে গ্যাপগুলো (ঘাটতি) আছে সেগুলো পূরণ করতে হবে। পাশাপাশি নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সেখানে বিভিন্নভাবে রাষ্ট্র ও সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে।

জাগো নিউজ: নারী-শিশু নির্যাতনের পেছনে পারিবারিক ও রাজনৈতিক কারণ দেখা যায়। এখান থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

ফওজিয়া মোসলেম: নির্যাতনের পেছনে পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি ক্ষমতার ব্যবহার রয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক। আমরা দেখি, যতগুলো অপরাধ হয় সব অপরাধের মধ্যে ক্ষমতাসীন যারা—আমি শুধু রাষ্ট্রীয় বা সরকারদলীয় ক্ষমতা বলছি না; আমি বলছি, আমার চেয়ে ক্ষমতা বেশি হলেই হলো, সেখানে আমাদের দেশে যে অবাধ দুর্নীতি, এর ফলে যে কালো টাকা জমছে, এর মাধ্যমে ক্ষমতার কাছাকাছি চলে যাচ্ছে এবং সবাইকে কিনে ফেলছে—তারা জড়িত থাকে। কাজেই ক্ষমতা থেকে যদি অপরাধকে আলাদা না করা যায়, তাহলে অপরাধ বন্ধ হবে না। কেননা ক্ষমতা আর অপরাধ যদি হাত ধরাধরি করে চলে তাহলে তো অপরাধ-নির্যাতন হবেই।

জাগো নিউজ: তাহলে এসব নির্যাতন-অপরাধ প্রতিরোধে চ্যালেঞ্জগুলো কী?

ফওজিয়া মোসলেম: প্রথমেই ক্ষমতা থেকে অপরাধকে আলাদা করতে হবে। পাশাপাশি যে আইন রয়েছে সেগুলোর বাস্তবায়ন করতে হবে। সেখানে ভুক্তভোগী পরিবারের আইনের আশ্রয় গ্রহণ করা থেকে শুরু করে মামলাগুলোর প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আইন সবার জন্য সমান, সে বিষয়টি বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা জরুরি। এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে এবং অপরাধ কমে আসবে বলেও মনে করি।

নারী-শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলাও জরুরি বলে মনে করেন ডা. ফওজিয়া মোসলেম

জাগো নিউজ: নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠনে সরকার, নারী সংগঠন ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভূমিকাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ফওজিয়া মোসলেম: স্বাধীনতার ৫০ বছর ধরেই আমরা নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। নারীকে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলার পাশাপাশি পুরুষদেরও সচেতন করতে আমরা চেষ্টা করি, যেন তারা নারীবান্ধব মানুষ হন। সরকারও চেষ্টা করে যাচ্ছে। সে জায়গা থেকে যদি নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারের গৃহীত সব পদক্ষেপের সঙ্গে আমরা সবাই এক হয়ে কাজ করতে পারি, তাহলে নারী-পুরুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণে মানবিক রাষ্ট্র গঠন সহজ হবে।

জাগো নিউজ: আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ফওজিয়া মোসলেম: জাগো নিউজকেও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।

এওয়াইএইচ/এইচএ/এমকেএইচ