বেলুকা বেগম (৫৫)। জীবনের মানে বোঝার আগেই বাঁধেন সংসার। বাবার কষ্টের সংসার থেকে চলে আসেন স্বামীর সংসারে। সুখ ও ঠাঁই দুটোই হবে, এমন স্বপ্ন ছিল শুরুতে। স্বামী, সংসার ও সন্তান লালনপালন—এসব কিছু বোঝার আগেই কোলজুড়ে একে একে আসে দুই সন্তান। তারপরও মনে জোর ছিল, স্বামী পাশে থাকলে সবই সামলে নেবেন। তা আর হলো কই? কুকুরের কামড়ে মারা গেলেন স্বামী। বেলুকার জীবন হয়ে যায় দুর্বিষহ।
Advertisement
একদিকে উপকূলীয় এলাকায় সিডর, আইলা, আম্ফানসহ নানা ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে যুদ্ধ করেই জীবন যাপন করতে হয়; তার ওপর নেই ভিটেমাটি, মাথা গোঁজার ঠাঁই। নেই উপার্জনক্ষম কোনো পুরুষ। দুই সন্তান নিয়ে কোথায় যাবেন, কোথায় থাকবেন, কী খাবেন, কী হবে সন্তানদের ভবিষ্যৎ? এসব নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান বেলুকা।
এই নিঃস্ব বেলুকার সহায় হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জীবনের জন্য পরম আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভাব হয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় একটু জায়গা আর একটি ঘর মেলে বেলুকার।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বাগেরহাট জেলার উপকূলীয় উপজেলা শরণখোলার বেলুকা বেগম জাগো নিউজকে বলছিলেন তার জীবনের গল্প। এই জীবন-সংগ্রামে প্রধানমন্ত্রীর ঘর উপহার প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, তার বেঁচে থাকার আশা জেগেছে নতুন করে। মাথা গোঁজার অবলম্বন তাকে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে।
Advertisement
বেলুকা বেগম জানান, প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর শুরু হয় তার জীবনের চরম যুদ্ধ। নিজের জীবিকা ও সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মানুষের দ্বারে দ্বারে কাজ করে জীবন চালাতেন। কখনো এখানে, কখনো সেখানে থাকতেন। কাজের বিনিময়ে খাদ্য জোটে। কিন্তু মাথা গোঁজার ঠাঁই? তা তো নেই। দুর্বিষহ কষ্টের জীবনে মাথা গোঁজার জন্য সুলতান আহমদ নামের একজনের সঙ্গে ফের ঘর বাঁধেন। কিন্তু আগলে রাখার বদলে নির্যাতন করতে থাকেন বেশি। নানা চিন্তা করে একে একে সন্তানও নেন পাঁচটি। কিন্তু সুখ তো অধরা। সে সংসারও করা হয়নি।
জীবনযুদ্ধে পোড় খেয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করেন। পরের বাড়ি কাজ করে, পরের জায়গায় থেকে পাঁচ মেয়েকে বিয়ে দেন। ছেলেদেরও কাজে লাগিয়ে দেন। কিন্তু তাতে তো খাবার জোটে; ঠাঁই হয় না। যখন যেখানে ঘর করেন; হয় তাড়িয়ে দেয়, নয় প্রকৃতি নিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘২০০৭ সালে সিডরের ভয়ে খাটের নিচে লুকাইছি, তাতেও কাজ হয়নি। অফিসাররা এসে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে গেছে, আর ঘর তো নিয়ে গেছে সিডরে।’
বেলুকা জানান, এমন কষ্টের মাঝেই শোনেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘর করে দিচ্ছেন। ইউএনওর কাছে নিজের জীবনের গল্প বলতেই তাকে জায়গা বরাদ্দ দিয়ে ঘর করে দেয়া হয়।
বেলুকা বলেন, ‘শেষ বয়সে এসে অন্তত নিশ্চিন্তে রাত কাটাতে পারছি, এর চেয়ে সুখ আর নেই। জীবনে বহু কষ্ট করেছি, (চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে) এখন অন্তত মাথা গোঁজার ঠাঁই পাইছি। এজন্য আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই।’
Advertisement
বেলুকার মতো প্রতিবেশী মাসুম দর্জি, ইব্রাহিম শিকদারসহ অনেকের দুর্বিষহ জীবনের অবসান হয়েছে এভাবে জায়গা ও ঘর পাওয়অর মধ্য দিয়ে। শরণখোলায় ২০০-সহ বাগেরহাটের ৪৩৩টি পরিবারকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে।
শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সরদার মোস্তফা শাহীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি এই কাজ করতে করতে গিয়ে কত শত মানুষের দুঃখ দুর্দশা শুনেছি। মানুষের অসহায়ত্ব দেখেছি। এই উপজেলায় ২০০ পরিবার বাড়ি পাচ্ছে। এটা প্রধানমন্ত্রীর মহান উদ্যোগ। এর আগে কেউ এমন উদ্যোগ নেয়নি। এই উদ্যোগে মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে, এটা অনেক বড় প্রাপ্তি।’
বাগেরহাট জেলা প্রশাসক আ ন ম ফয়জুল হক জাগো নিউজকে জানান, পুরো জেলায় ৪৩৩ পরিবার এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় আসছে।
প্রসঙ্গত, মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৭০ হাজার পরিবারকে বাড়ি করে দেয়া হয়েছে। ২৩ জানুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একযোগে এসব উদ্বোধন করবেন। এরপর ধাপে ধাপে প্রায় নয় লাখ পরিবারকে এ প্রকল্পের আওতায় বাড়ি করে দেয়ার পরিকল্পনা আছে সরকারের।
এসইউজে/এমআরআর/এইচএ/এমএস