দেশের অর্থনৈতিক লাইফলাইন হিসেবে পরিচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কটি শীতলক্ষ্যা, মেঘনা ও গোমতী নদীর ওপর দিয়ে চলে গেছে। এই নদীগুলোর ওপর কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতী দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ এবং বিদ্যমান সেতুগুলোর পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালের এপ্রিলে। শেষ হওয়ার কথা ২০২১ সালের অক্টোবরে। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৯৯ দশমিক ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ যথাসময়েই কাজ শেষ হতে চলছিল। আরও কিছু কাজ নতুন যুক্ত হওয়ায় মাত্র তিন মাস সময় বাড়ানো হচ্ছে। অর্থাৎ প্রকল্পটির কাজ ২০২২ সালের জানুয়ারিতে শেষ হতে যাচ্ছে।
Advertisement
যেখানে দেশের অধিকাংশ প্রকল্পের মেয়াদ বছরের পর বছর বাড়ানো হচ্ছে, সেখানে এ প্রকল্প যথাসময়েই শেষ হতে যাচ্ছে। প্রকল্পটির কৃতিত্ব শুধু এখানেই নয়; এটি বাস্তবায়নের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল সেখান থেকেও এক হাজার ৪৬৪ কোটি ৯ লাখ ৪৩ হাজার টাকা সাশ্রয় হচ্ছে, যা মোট বরাদ্দের ১৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।
যেখানে সরকারের প্রকল্পগুলোয় নানা অজুহাতে খরচ বাড়ানোর অঘোষিত রীতি প্রচলিত রয়েছে, সেখানে কম খরচে কাজ শেষ করে টাকা ফেরত দেয়ার ঘটনা প্রায় অবিশ্বাস্য হলেও জাপানিদের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তার এ প্রকল্পে এমনটাই ঘটতে যাচ্ছে।
এ সম্পর্কিত ‘কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতী দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ এবং বিদ্যমান সেতুগুলোর পুনর্বাসন’ প্রকল্পের প্রথম সংশোধন প্রস্তাব করা হয়েছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) আগামী সভায় প্রকল্পটির সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদন হওয়ার কথা রয়েছে।
Advertisement
সংশোধিত প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রকল্পটির মোট খরচ ছিল আট হাজার ৪৮৬ কোটি ৯৩ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। সেতু তিনটি নির্মাণে পুরো টাকা না লাগায় প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় এক হাজার ৪৬৪ কোটি ৯ লাখ ৪৩ হাজার টাকা কমিয়ে সাত হাজার ২২ কোটি ৮৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়। অর্থাৎ সেতু তিনটি করার জন্য যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল, সেই অর্থের পুরোটা লাগছে না।
প্রকল্পে মোট আট হাজার ৪৮৬ কোটি ৯৩ লাখ ৮৩ হাজার টাকা বরাদ্দের মধ্যে সরকার দুই হাজার ৫৭ কোটি ৬৪ লাখ ৮৭ হাজার এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ঋণ দিচ্ছিল ছয় হাজার ৪২৯ কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার টাকা।
প্রকল্প সূত্র জানায়, এ সেতু তিনটি যৌথভাবে নির্মাণ করছে জাপানের ওবায়েশি করপোরেশন, সিমিজু করপোরেশন, জেএফই করপোরেশন এবং আইএইচআই ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিস্টেম কোম্পানি লিমিটেড।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর।
Advertisement
নাম না প্রকাশের শর্তে প্রকল্পের শীর্ষপর্যায়ের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের এই সফলতায় বাংলাদেশ ও জাপান– উভয়পক্ষেরই কৃতিত্ব। পাশাপাশি সেতু তৈরি করার জন্য …। যেমন ওপেন হার্ট সার্জারি না করা পর্যন্ত বোঝা যায় না যে ক্যান্সার কত দূর ছড়াইছে। একইভাবে পুরাতন সেতুগুলো মেরামত করার আগ পর্যন্ত বোঝা যায় না, কত লাগতে পারে। পরে যখন খোলা হলো তখন দেখা গেল ড্যামেজ ওই পরিমাণে নাই। ড্যামেজটাকে ইঞ্জিনিয়ারিংভাবে সমাধান করে সেখান থেকে কিছু টাকা সেভ করা হয়েছে। কাজটা যখন দেয়া হয়, তখন কনসালটেন্সিতে প্রায় ১২০ কোটি টাকা সেভ করা হয়। মানে বাংলায় বলে মোলামুলি করে দর কমানো। তারপর বিভিন্ন আইটেম যেগুলো না করলেও চলে, সেগুলোও বাদ দেয়া হয়েছে। নতুন যে সেতু, তার উপরি কাঠামোতে কিছু টাকা সাশ্রয় হয়েছিল। তারপর ইমার্জেন্সি ফান্ড ছিল একটা, ওখানে এত টাকা লাগে নাই। ওখান থেকে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার মতো, আরও ছোট ছোট জায়গা থেকে সাশ্রয় করা হয়েছে। এভাবে জাপানি অংশের কাজ থেকে মোট প্রায় ৭০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে।’
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আর বাংলাদেশ সরকারের অংশে ৭০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে জিডিতে। জাপানের পরিকল্পনা ছিল যে, বিদেশ থেকে পাথর ও রড আনবে। কিন্তু দেখা গেল বাংলাদেশের কিছু রডের মান অনেক ভালো এবং তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় টিকে যাওয়াতে আমদানি করা লাগে নাই। রড তারা বাংলাদেশের মার্কেটে একটু কম মূল্যেই পেয়েছে। সে সময় রডের দাম একটু কম ছিল।’
তিনি বলেন, ‘জাপানের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো পথর আমদানি করতে চেয়েছিল ভারত থেকে। আমাদের শর্ত ছিল, আমদানি করলে তাদেরকেই করতে হবে। একজনের লাইসেন্সে অন্যজন আমদানি করতে পারবে না। জাপানের ঠিকাদাররা যখন নিজেরা আমদানি করতে গেল, দেখে যে সময় লাগে। তার চেয়ে স্থানীয় বিক্রেতাদের কাছ থেকে কিনলে প্রায় সমান খরচ পড়ে। সুতরাং তারা বাংলাদেশের স্থানীয় বাজার থেকে কিনে নিয়ে কাজটা শেষ করে দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়া এক কাপ চা ভাগাভাগি করে খেলে তিনজন খাওয়া যায়। এই বিষয়টা এখানে ঘটেছে। এটা সরকারের কৃতিত্ব। কোনো কর্মচারী বা প্রকল্প পরিচালকের একক কৃতিত্ব না। কর্মীরা কাজ করেছেন, কনসালটেন্টরা কাজ করেছেন, ঠিকাদাররা কাজ করেছেন, মন্ত্রণালয় কাজ করেছেন, মন্ত্রী কাজ করেছেন।’
যেসব খাতে খরচ কমেছে ও বেড়েছেপ্রকল্পটির বিভিন্ন খাতে যেমন খরচ কমেছে, তেমনি বেড়েছেও।
সূত্র জানায়, কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতী দ্বিতীয় সেতু নির্মাণে সুপার স্ট্রাকচার খাতে ১৫২ কোটি ৫৮ লাখ ১১ হাজার টাকা খরচ কমেছে এবং এর সাব-স্ট্রাকচার খাতে ৮৫৬ কোটি ৮৫ লাখ ৬৯ হাজার টাকা খরচ বেড়েছে।
বিদ্যমান সেতুগুলো পুনর্বাসনে সুপার স্ট্রাকচার খাতে ১৬ কোটি ৪১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা খরচ কমেছে এবং সাব-স্ট্রাকচার খাতে খরচ কমেছে এক হাজার ৪১৫ কোটি ৮৫ লাখ ৮২ হাজার টাকা।
অ্যালোয়েন্স ফর প্রাইস অ্যান্ড ফিজিক্যাল অ্যাডজাস্টমেন্ট খাতে ব্যয় কমেছে ৫০২ কোটি ৯১ লাখ ৭৯ হাজার টাকা।
প্রকল্প অফিস ভবনের পরিমাণ ৩৩ হাজার ৭৫০ বর্গফুট বাড়ানো হয়েছে এবং এ খাতে খরচ বেড়েছে ২৫ কোটি ৮২ লাখ ৮৯ হাজার টাকা।
আর্থওয়ার্ক অন এম্বেংকমেন্টের পরিমাণ এক লাখ ২১ হাজার ৩ ঘন মিটার বেড়েছে এবং এ খাতে ২৬ কোটি ৮৫ লাখ ৩ হাজার টাকা খরচ বেড়েছে।
পেভমেন্ট নির্মাণের পরিমাণ ৯২ হাজার ৮৯০ বর্গমিটার বেড়েছে এবং এ খাতে ২৩৩ কোটি ৭৭ লাখ ৪৩ হাজার টাকা খরচ বেড়েছে।
মিসেলেনিয়াস আইটেমের খরচ বেড়েছে ২৭৭ কোটি ৮৯ লাখ ১২ হাজার টাকা।
আর সিডি/ভ্যাট খাতে ৭৯৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা খরচ কমেছে।
নতুন করে যেসব খরচ বাড়ছেমূল উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) অ্যাডিশনাল সিকিউরিটি কস্ট, রিলোকেশন অব ইউটিলিটিস, রিভার ট্রেইনিং ওয়ার্ক, ইলেক্ট্রিক ফ্যাসিলিটিস, টাইম রিকভারি কস্ট অ্যান্ড রিমেইনিং সিকিউরিটি কস্ট এবং মেইনটেন্যান্স অ্যান্ড ট্রেইনিং অব কেএমজি অফিসার্স ডিউরিং ডিফ্যাক্টস নোটিফিকেশন পিরিয়ড (ডিএনপি) খাতে কোনো বরাদ্দ ছিল না। ফলে এসব খাতে যথাক্রমে ৭২ কোটি ৭৮ লাখ, ১৩ কোটি ৫৬ লাখ, ৩৯ কোটি ৪০ লাখ, ৮৯ কোটি ৯৭ লাখ, ৮৮ কোটি ১৬ লাখ এবং ১৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।
পাঁচটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের জন্য ৩৪ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। ইন্টারসেকশন উন্নয়নের জন্য একটি ইন্টারসেকশনসহ ১৫টি বাস-বে এবং ১৫টি বাস শেল্টারসহ মোট ৪১ কোটি ৯৮ লাখ ৮৮ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া ইম্প্রুভমেন্ট সাব-গ্রেডের পরিমাণ এক লাখ ২৬ হাজার ৪৯১ ঘনমিটারের জন্য ১৭ কোটি ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকার; কমন এক্সাভেশন অ্যান্ড স্ট্রাকচারাল এক্সাভেশনের পরিমাণ দুই লাখ ১১ হাজার ৬৪১ ঘনমিটারের জন্য এ খাতে ৬৯ কোটি ৭১ লাখ ৪৩ হাজার এবং ১৩ হাজার ৫৭২ মিটার ড্রেন নির্মাণের জন্য ২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে প্রথম সংশোধনীতে।
এ বিষয়ে কথা বলতে প্রকল্প পরিচালক আবু সালেহ মো. নুরুজ্জামানের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তার সাড়া মেলেনি।
সওজ বলছে, চলমান যানবাহনের চাপের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়ক (এন-১) ইতোমধ্যে চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। এ মহাসড়কটি দেশের অন্যতম প্রধান তিনটি নদী শীতলক্ষ্যা, মেঘনা ও গোমতীকে অতিক্রম করেছে। নদী তিনটির ওপর আগে নির্মিত যথাক্রমে চার লেনবিশিষ্ট কাঁচপুর, দুই লেনবিশিষ্ট মেঘনা ও গোমতী সেতু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বর্ধিত যানবাহন চলাচলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। এছাড়া বিদ্যমান সেতুগুলোর কাঠামোগত অবক্ষয় এবং নদীর তলদেশে ভূমিক্ষয়ের ফলে সেতুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে দ্বিতীয় সেতুগুলো নির্মাণ এবং পুরোনো সেতুগুলো পুনর্বাসন জরুরি হয়ে পড়ে। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার দ্রুত ও নিরাপদ পরিবহন সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যমান সেতু সংলগ্ন স্থানে আরও তিনটি চার লেনবিশিষ্ট সেতু নির্মাণ এবং বিদ্যমানগুলো পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় জাইকার ঋণ ও কারিগরি সহায়তায় বর্তমান সেতু সংলগ্ন স্থানে আরও তিনটি নতুন সেতু নির্মাণ এবং পুরোনো সেতুগুলো পুনর্বাসনের পদক্ষেপ নেয়া হয়।
পিডি/এএএইচ/এইচএ/এমকেএইচ