সারা বিশ্বে করোনার তাণ্ডব চলছে। যারা বেঁচে আছেন, অনেকেই তাদের স্বজন হারিয়েছেন। আমাদের দেশেও দীর্ঘসময় ধরে করোনার প্রভাব চলছে। অনেকেই কাজ হারিয়েছেন, ব্যবসার পরিসর কমেছে। বিশেষ করে কাজ হারানো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে করোনার প্রকট ব্যাপক। এই মানুষগুলো কারো কাছে হাত পাততে পারে না, সাহায্য চাইতে পারেনা, যে কোন ধরনের কাজও করতে পারে না। এরাই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে। করোনার এই দীর্ঘমেয়াদী দুর্যোগে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কিছু মানুষ কিন্তু সুবিধা পেয়ে যায়। এটা অনেক সময় তাদের বুদ্ধির কারণে হয়ে থাকে। দুটি ঘটনা ব্যাখ্যা করছি, তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
Advertisement
ঘটনা-১ আমার এক স্কুলবন্ধুর সাথে দেখা হল। অনেকদিন দেখা নেই। ব্যস্ততার কারণ জিজ্ঞেস করতেই বললো, বাড়ির কাজ শুরু করছে। এজন্য বেশি বের হতে পারছে না। কথার এক পর্যায়ে সে বললো, করোনায় একদিক দিয়ে লাভ হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে? সেই বন্ধু বললো, করোনায় রডের দাম ৫৫ টাকা হয়ে গিয়েছিল। একবারে দুইতলা করার করার জন্য যত টন রড লাগবে, সেই টাকা দোকানদারকে এডভান্স দিয়ে রেখেছিলাম। এখন রডের দাম ৭০ টাকা। হিসাব করে দেখলাম, শুধু রড থেকেই প্রায় ২ লাখ টাকা বেঁচে যাচ্ছে। তাকে খুব খুশি লাগল। মনে হচ্ছিল যেন যুদ্ধ জয় করে ফিরেছে।
ঘটনা-২ আমার এক পরিচিতজন ২০ হাজার টাকা দিয়ে ঘর ভাড়া থাকতো। করোনার এই সময় অনেকেই ঘর ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে গেছে। অনেকেই আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্য রাখতে কিছুটা কম টাকার বাসা ভাড়া নিয়েছেন। সেই পরিচিত ব্যক্তি যে বিল্ডিংয়ে থাকতো, তার পাশের বিল্ডিংয়ের কয়েকটি ফ্ল্যাট কয়েক মাস ধরে ফাঁকা পড়েছিল। ভাড়া হচ্ছিল না। এখন সেই বাড়ির মালিক ফ্ল্যাটের ভাড়া কমিয়ে দিয়েছে। দ্রুত ভাড়াটিয়া দরকার। আমার পরিচিতজন ১৬ হাজার টাকা দিয়ে সেই বাড়ির ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। এখন তার প্রতি মাসে ৪০০০ টাকা মাসিক ভাড়া কম খরচ হচ্ছে। ফ্লাট কিন্তু দুইটি একই রকম।
উপরের দুটি ঘটনাকে খারাপভাবে দেখার সুযোগ নাই, যদিও তারা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে।
Advertisement
কিন্তু কেউ কেউ আবার অন্যায়ভাবে চাতুরিপনার মাধ্যমে করোনাকালের এই মহামারির সময় অন্যের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সহজভাবে বলা যায়, সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে তাদের অর্থ আত্মসাৎ করছেন। শীতের শুরুতে অনেক উন্নত দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব অনেক বেড়ে গিয়েছিল। অনেক দেশ লকডাউন দিয়ে দিল। ধারণা করা হয়েছিল, আমাদের দেশেও এই শীতে করোনা বেড়ে যাবে। বিষয়টা প্রচার হওয়ার পর, যে মাস্কের বক্স ২০০ টাকা ছিল, ঠিক দুই এক দিনের ব্যবধানে সেই মাস্কের বক্স ৪০০ টাকা হয়ে গেল। একইভাবে, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দামও বেড়ে গেল। দোকানদারকে প্রশ্ন করলে এক কথায় উত্তর পাওয়া যায়, সাপ্লাই নাই।
এক-দুইদিনের ব্যবধানেই সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেল? আর সাপ্লাই না থাকলে মাস্কের দাম যেমন খুশি তেমন রাখা যায়? প্রতিটা বক্সের উপর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য লেখা থাকে। এর চেয়ে বেশি টাকা নেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু সেটাকেও তোয়াক্কা করা হয় না। আর সাধারণ মানুষ যখন আতঙ্কে থাকে, তখন যে দাম চাওয়া হয়, সেটা দিয়েই কিনে ফেলে। প্রতিবাদ করার ভাষাও হারিয়ে ফেলে।
এর ফলে যেটা হলো, সাধারণ মানুষজন বাধ্য হয়েই বেশি দাম দিয়ে সেই মাস্ক, স্যানিটাইজার কিনলো। অর্থাৎ মহামারীর মধ্যেও কিছু সুযোগ সন্ধানী মানুষ অন্যায়ভাবে অন্যের কষ্টার্জিত টাকা নিজের পকেটে ভরে ফেলে। এদের সংখ্যাটা অনেক কম কিন্তু তারপরেও আছে। এদের কাছে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের কোনো বিচার নাই। টাকাই মুখ্য। এভাবে অনেকেই অন্যায় ভাবে অর্থ আয় করছেন। সেই উদাহরণে নাইবা গেলাম।
এর বাইরেও ই-কমার্স কিংবা অনলাইন ডেলিভারির ব্যবসায়ের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকেই ঘরের বাইরে বের হওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। ঘরে থেকেই অর্ডার দিচ্ছেন। বাসায় পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে। এটা ভালো একটি দিক। কিন্তু এর বিপরীতে যখন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অনলাইনে ভাল মানের পণ্য দেখিয়ে নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করে সেটা অবশ্যই ব্যবসায়ের নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। কিন্তু এভাবেও তারা লাভবান হচ্ছে।
Advertisement
যে কোনো দুর্যোগকালে অধিকাংশ মানুষ অর্থ কষ্টে থাকলেও, কিছু কিছু মানুষ এসবের মধ্যেও লাভ খুঁজে বের করতে পারে। কেউ সঠিক উপায়ে বুদ্ধি খাটিয়ে, আবার কেউ অন্যায় ভাবে অন্যের অর্থ আত্মসাৎ করে। কে কোন উপায়ে অর্থ আয় করবে, সেটা একমাত্র তারই বিবেচনা এবং বিবেক বোধের উপর নির্ভর করে।
লেখক : অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এবং যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
এইচআর/এমকেএইচ