বিনোদন

সুভাষ দত্তের প্রয়াণ দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলি

ঢাকাই ছবির কিংবদন্তি তিনি। তার হাত ধরে এ দেশের চলচ্চিত্র পেয়েছিলো নির্মাণের ভিন্নতা ও বৈচিত্র। অভিজ্ঞতার ঝুলির ওজন বাড়িয়ে তিনি একাধারে দায়িত্ব পালন করেছেন চলচ্চিত্রের প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা, চলচ্চিত্র চিত্রশিল্পী, চিত্রনাট্যকার ও শিল্প নির্দেশক হিসেবে। বলছি সুভাষ দত্তের কথা। আজ সোমবার এই কৃতী চলচ্চিত্রকারের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১২ সালের ১৬ নভেম্বর বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগে পরলোকে যাত্রা করেন এই অসামান্য প্রতিভা। সুভাষ দত্তের জন্ম ১৯৩০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরের মুনশিপাড়ায় মামার বাড়িতে। পৈতৃক বাড়ি বগুড়া জেলার চকরতি গ্রামে। বসবাস করতেন ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের নিজ বাড়িতে। স্ত্রী সীমা দত্ত ২০০১ সালের অক্টোবরে প্রয়াত হন। তিনি দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক।১৯৫৭ সালে ভারতের হাইকমিশনের উদ্যোগে একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে ওয়ারীতে। সেখানে দেখানো হয় সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী  চলচ্চিত্রটি। পথের পাঁচালী দেখেই তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুপ্রাণিত হন।তবে আজকালকার নির্মাতাদের মতো ষাটের দশকে চলচ্চিত্রে কাজ করাটা অতো সহজ ছিলো না। স্বভাবতই সুভাষ দত্তকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আসতে হয়েছে কিংবদন্তির রাজপথে। তিনি কর্মজীবন শুরু করেন ভারতের বোম্বেতে। সেখানে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে একটি ছায়াছবির পাবলিসিটির স্টুডিওতে মাত্র ত্রিশ টাকা মাসিক বেতনে কাজ শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে ভারত থেকে ঢাকায় ফিরে যোগ দেন প্রচার সংস্থা এভারগ্রিন -এ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে সুভাষ দত্তের কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল চলচ্চিত্রের পোস্টার এঁকে। এ দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’র পোস্টার ডিজাইনার ছিলেন তিনি। মাটির ‘পাহাড়’ চলচ্চিত্রে আর্ট ডিরেকশনের মধ্যে দিয়ে তার পরিচালনা জীবন শুরু হয়। এরপর তিনি এহতেশাম পরিচালিত ‘এ দেশ তোমার আমার’ ছবিতে প্রথম অভিনয়ের সুযোগ পান। আর পরিচালক হিসেবে অভিষিক্ত হন চলচ্চিত্র ‘সুতরাং’ (১৯৬৪) দিয়ে। প্রধান অভিনেতা হিসেবে তিনি অভিনয় করেন সেই সময়কার নবাগতা অভিনেত্রী কবরীর বিপরীতে। এটি বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সম্মাননা লাভ করেছিল।  ১৯৬৫ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট চলচ্চিত্র উৎসবে সুতরাং দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার লাভ করে। এ ছাড়া মস্কো চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৬৭, ১৯৭৩ ও ১৯৭৯) ও নমপেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (১৯৬৮) পুরস্কৃত হয়েছে সুভাষ দত্তের চলচ্চিত্র। ১৯৭৭ সালে ঘোষিত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-এ তার প্রযোজনা-পরিচালনার বসুন্ধরা চলচ্চিত্রটির জন্য সেরা পরিচালক ও প্রযোজকসহ মোট পাঁচটি পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে তার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত একুশে পদকে ভূষিত হন। তবে সুভাষ দত্তের জীবনের সেরা অর্জন তিনি একজন শিল্পী গড়ার কারিগর হিসেবে ঢাকাই ছবিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তার হাত ধরেই চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে কবরী, সুচন্দা, উজ্জল, শর্মিলী আহমেদ, ইলিয়াস কাঞ্চন, আহমেদ শরীফ ও মন্দিরার। সেইসাথে বিভিন্ন সময় তিনি নির্মাণ করেছেন অসংখ্য দর্শক নন্দিত চলচ্চিত্র। তারমধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ ও ১৯৭৭ সালে আলাউদ্দিন আল আজাদের বিখ্যাত উপন্যাস ২৩ নম্বর তৈলচিত্র অবলম্বনে ‘বসুন্ধরা’ চলচ্চিত্র দুটি আজও চলচ্চিত্র সমালোচকদের আলোচনার বিষয়। সত্তর দশকের শেষের দিকে ড. আশরাফ সিদ্দিকীর লেখা গল্প গলির ধারের ছেলেটি অবলম্বনে তিনি নির্মাণ করছিলেন ‘ডুমুরের ফুল’ চলচ্চিত্র। পাশাপাশি রাজধানীর বুকে, সূর্যস্নান, তালাশ, রূপবান, মিলন, নদী ও নারী, ভাইয়া, ক্যায়সে কাহু, আখেরি স্টেশন, সোনার কাজল, দুই দিগন্ত, সমাধান প্রভৃতি ছবিতে অভিনেতা এবং কাগজের নৌকা, আয়না ও অবশিষ্ট, আবির্ভাব, বলাকা মন, সবুজ সাথী, সকাল সন্ধ্যা, ডুমুরের ফুল, নাজমা, স্বামী স্ত্রী, আবদার, আগমন, শর্ত, সহধর্মিণী, সোহাগ মিলন, পালাবদল, আলিঙ্গন, বিনিময়, আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি ছবিতে পরিচালক হিসেবে সুভাষ দত্তের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে রইবে।

Advertisement

সূত্র : অনলাইনএলএ/আরআইপি