করোনা মহামারির মধ্যেও অত্যধিক রেমিট্যান্সপ্রবাহ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। দেখা দিয়েছে বিভিন্ন প্রশ্ন। মহামারির মধ্যে এত বেশি রেমিট্যান্স কোথা থেকে আসছে, কীভাবে আসছে এবং ভবিষ্যতে আরও কতদিন এভাবে আসবে এসব প্রশ্ন তার মধ্যে অন্যতম।
Advertisement
গত বছর দুই লাখেরও বেশি প্রবাসী দেশে ফিরে এলেও প্রবাসী আয়ের রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, কিছু দেশ থেকে প্রবাসীরা তাদের শেষ সঞ্চয় নিয়ে একেবারে দেশে ফেরার কারণে এ রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়েছে।
আবার সরকারি ২ শতাংশ প্রণোদনাকেও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকেই। কিন্তু এত সব প্রশ্নের উত্তরে এই কারণগুলো কতটা যৌক্তিক তা খুঁজে দেখার সময় এসেছে।
রোববার (১৭ জানুয়ারি) ভার্চুয়ালি আয়োজিত এক সংলাপে এসব মন্তব্য করেন এসডিজি প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
Advertisement
এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘সাম্প্রতিক প্রবাসী আয়/রেমিট্যান্সপ্রবাহ এত টাকা আসছে কোথা থেকে?’ শীর্ষক এ ভার্চুয়াল সংলাপের আয়োজন করা হয়।
এসডিজি প্ল্যাটফর্মের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে আমাদের পাশের দেশ ভারতের রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমেছে ৩২ দশমিক ৩ শতাংশ। ফিলিপাইনের প্রবাহ কমেছে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ। কিন্তু এর বিপরীতে বাংলাদেশের রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়েছে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের সংগৃহীত রেমিট্যান্সের পরিমাণ দুই হাজার ১৭৪ কোটি ১৮ লাখ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে শুধু ছয় মাসের ব্যবধানে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৮ শতাংশ।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশিসের (এনআরবি) চেয়ারপারসন এম এস শেকিল চৌধুরী বলেন, একটি সময় হুন্ডির মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণ বিদেশি অর্থ দেশে আসত। কিন্তু সেটাও এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে। আবার প্রবাসীরা প্রতিবছর দুই থেকে একবার দেশে আসার সময় অনেক ক্যাশ টাকা বয়ে আনতেন। এখন সেটার প্রয়োজন হচ্ছে না। কারণ ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠালে দুই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। এছাড়া যেসব ব্যবসায়ী হুন্ডির মাধ্যমে ভারি লেনদেন করতেন তাদের মধ্যেও বৈধ পথে টাকা লেনদেনের আগ্রহ বেড়েছে।
সিপিডি জানায়, কোভিড-১৯ মহামারির ধাক্কায় পুরো বিশ্বের অর্থনীতি পর্যুদস্ত। কমে গেছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। বিপুল সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক কাজ হারিয়ে দেশে ফিরেছেন। বিপুল সংখ্যক তাদের কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারেননি। প্রাবাসী আয়ের ক্ষেত্রে এর প্রভাব নিয়ে সবাই শঙ্কিত ছিলেন এবং এ কারণে বিশ্বব্যাপী প্রবাসী আয় হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে যে, প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রেকর্ড করে চলেছে। প্রবাসী আয়ের এ ঊর্ধ্বমুখী ধারা যেমন আমাদের জন্য স্বস্তিদায়ক, ঠিক একইভাবে তা নিয়ে রয়েছে নানা আলোচনা। এই অর্থের উৎস নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক।
Advertisement
রিফিউজি অ্যান্ড মাই গ্রিটিং মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) এর চেয়ারপারসন অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতি মানে প্রবাসীরা ভালো আছেন এটা ভাবা উচিত নয়। তবে যেসব প্রবাসী ইতোমধ্যেই কাজ হারিয়ে দুরবস্থার মধ্যে রয়েছেন তাদের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিত।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, প্রবাসী আয়ের ওপর সরকারি ২ শতাংশ প্রণোদনা যদি আরও কিছুটা বাড়ানো যায় তবে এই প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে। এরকম প্রণোদনা যদি আমরা পোশাকখাতের জন্য করতে পারি তাহলে আমরা আরও লাভবান হতে পারব। ইতোমধ্যেই ফিরে আসা বাংলাদেশিদের জন্য ২০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। যেই টাকাগুলো ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হবে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে।
তিনি আরও বলেন, এটা নিয়ন্ত্রণ করবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। কিন্তু ব্যাংকটির যথেষ্ট লোকবল এবং অবকাঠামোর অভাবে টাকাগুলো এই মুহূর্তে বিতরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এটা নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। ফিরে আসা বাংলাদেশিদের কাজে লাগাতে মাত্র চার শতাংশ সুদে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা পর্যন্ত জামানতবিহীন এই ঋণের ব্যবস্থা করছে সরকার।
সমাপনী বক্তব্যে দেবপ্রিয় বলেন, পরিশ্রমী এসব মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা না গেলে সমস্যায় পড়বে বাংলাদেশ। কারণ কর্মসংস্থানের ওপর ভিত্তি করেই বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচি অর্জন নির্ভর করছে। অনেকেই বলছেন, রেমিট্যান্সের প্রবাহ ২০২১ সালে শেষ পর্যন্ত চলতে পারে আবার কারও কারও মতে অব্যাহত থাকবে এই প্রবৃদ্ধি।
তিনি আরও বলেন, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে ২০০ কোটি টাকা বিতরণ কার্যক্রম নেয়া হয়েছে তার মধ্যে মাত্র কয়েক লাখ টাকা বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। নানা অসুবিধার কারণে প্রবাসীদের কাছে টাকা পৌঁছাতে পারছে না তারা। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কেন অন্য কোনো সিডিউল ব্যাংকের মাধ্যমে এই ঋণ বিতরণ করা হবে না।
খেটে খাওয়া এইসব মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার জন্য যেকোনোভাবে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
ইএআর/এমআরআর/জেআইএম