জাতীয়

মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন সহজ করেছে বিদ্যুৎ প্রকল্প

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে সাগরের কোলঘেঁষে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দর। ২০২৬ সালে এটি চালু হওয়ার কথা। ইতোমধ্যে এর ফিজিবিলিটি ও প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন হয়েছে, বন্দর নির্মাণে জাপানের নিপ্পন কোই নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরামর্শক চুক্তিও সম্পন্ন হয়েছে।

Advertisement

এই মাতারবাড়িতেই চলছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বন্দরের অনেক কাজ এগিয়ে নিয়েছে বিদ্যুৎ প্রকল্পটি। বন্দরের জন্য যে চ্যানেল তৈরি হয়েছে সেটি ২৫০ মিটার চওড়া, ১৮ দশমিক পাঁচ মিটার গভীর এবং ১৪ দশমিক ৩ মিটার দীর্ঘ। এটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের অর্থায়নে সম্পন্ন হয়েছে। বন্দরের জন্য চ্যানেল তৈরিতে বিদ্যুতের প্রকল্পের করা ২৫০ মিটারের সঙ্গে আরও ১০০ মিটার চওড়া চ্যানেল, পৃথক জেটি নির্মাণ ও কনটেইনার রাখার স্থান হলে গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ আরও অনেক সহজ হবে।

এর আগে জাহাজ চলাচলের পথ নির্দেশনার জন্য ছয়টি বয়া চ্যানেল তৈরি করা হয়। পরে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এটি বন্দরে রূপ দিতে গভীর সমুদ্রবন্দর নামে প্রকল্প নেয়া হয়।

বিদ্যুৎ প্রকল্পের অর্থায়নে করা চ্যানেল দিয়ে গত ২৯ ডিসেম্বর প্রথম আন্তর্জাতিক জাহাজ ‘ভেনাস ট্রায়াম্ফ’ জেটিতে ভেড়ে। এ জাহাজ মূলত বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত জিনিস নিয়ে আসে। ইন্দোনেশিয়া থেকে ৪ দশমিক ৪ ড্রাফটের ১২০ মিটার জাহাজটি ৭৫০ মেট্রিক টন নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে আসে।

Advertisement

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, দুই ধাপে বন্দরের কাজ হবে। এর প্রথম ধাপে একটি কনটেইনার টার্মিনাল এবং বহুমুখী টার্মিনাল নির্মাণ হবে। চাহিদার আলোকে এটা আরও বাড়তে পারে। বন্দরের সঙ্গে চার লেনের একটি সড়ক নির্মাণ হবে, যেটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যুক্ত হবে।

এর মাধ্যমে দেশ পাঁচটি বন্দরের মালিক হবে। এগুলো হলো- চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, মোংলা সমুদ্রবন্দর, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর এবং মীরসরাই ইকোনমিক জোন সংলগ্ন প্রথম বেসরকারি সমুদ্রবন্দর।

সরকারের নেয়া গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি বিদায়ী বছরের ১০ মার্চ একনেকে অনুমোদন পায়। এ প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশি সংস্থা জাইকা দেবে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা, সরকারের জোগান দুই হাজার ৬৭১ কোটি, আর চট্টগ্রাম বন্দর অর্থায়ন করবে দুই হাজার ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। চলতি বছর (২০২১) প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হবে।

মাতারবাড়ি আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কোল-ফায়ার্ড পাওয়ার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা সমুদ্রবন্দরের কাজ সহজ করিনি, আমরাই করে দিয়েছি গভীর সমুদ্রবন্দর। বন্দর করার আগে গভর্নমেন্ট বলেছে, এটা আমরা করছি কয়লা আনার জন্য। এখন যেহেতু করা হয়েছে, তাই বলা হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। প্রথমে যদি গভর্নমেন্ট বলত এটা গভীর সমুদ্রবন্দর, তাহলে বিদেশিরা এটা করতে দিতো না। যে কারণে আগে ডিক্লেয়ার দেয়নি, এখন দিচ্ছে।’

Advertisement

বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে যে কয়েকটি সমুদ্রবন্দর রয়েছে তার কোনোটিই গভীর সমুদ্রবন্দর নয়। ফলে ডিপ ড্রাফটের ভেসেল এসব বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারে না। ডিপ ড্রাফট ভেসেলের জেটি সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মাতারবাড়িতে সমুদ্রবন্দর নির্মাণ বিষয়ে অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

একটি গভীর সমুদ্রবন্দরের উন্নয়নের পাশাপাশি আধুনিক কনটেইনারবাহী জাহাজ, খোলা পণ্যবাহী জাহাজ ও তেলবাহী ট্যাঙ্কারের জেটিতে ভেড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা, চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানি চাহিদা পূরণ এবং মাতারবাড়ি ও মহেশখালী অঞ্চলে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চলগুলোতে পণ্য পরিবহনে সহায়তা করাই এ বন্দর প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য।

মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ অংশের প্রকল্প পরিচালক মীর জাহিদ হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে জাপানের নিপ্পন কোই’র নেতৃত্বে মোট পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে রয়েছে- নিপ্পন কোইসহ জাপানের তিনটি এবং বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান দুটি হলো নিপ্পন কোই বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালট্যান্টস এবং ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্ট (ডিডিসি)।

তিনি বলেন, ‘এই পাঁচ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভ্যাট-ট্যাক্সসহ ২৩৪ কোটি টাকার পরামর্শক চুক্তি হয়েছে। তারা ডিজাইন-ড্রয়িং করবে, টেন্ডারের কাজ করবে, যখন অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হবে সেটা সুপারভিশন মনিটরিংও করবে তারা। মানে ২০২৬ সালের শেষ পর্যন্ত তারা কাজ করবে।’

২০২২ সালের শেষ দিকে মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ দৃশ্যমান হবে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘ডিজাইন হলে এর ভিত্তিতে টেন্ডার ডকুমেন্ট প্রস্তুত করা হবে। তারপর দরপত্র আহ্বান হবে, সেগুলো মূল্যায়ন হবে, চুক্তি হবে। এসব শেষ করে ২০২২ সালের জুলাই থেকে আশা করছি মাঠে কাজ শুরু হবে। ওই বছরের শেষ দিকে হয়তো আমাদের কাজ দৃশ্যমান হতে শুরু করবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার চ্যানেল খনন করা হয়েছে। যার গভীরতা সাড়ে ১৮ মিটার এবং চওড়া ২৫০ মিটার। আমাদের প্রকল্পের আওতায় আরও ১০০ মিটার বাড়িয়ে মোট ৩৫০ মিটার চওড়া করা হবে। আমরা ১০০ মিটার বাড়াবো, এটাও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় হবে। মানে আমাদের সঙ্গে তাদের একটা চুক্তি আছে। এই ১০০ মিটার ওদের কন্ট্রাক্টর দিয়েই করানো হবে। পরে তারা আমাদের কাছে চ্যানেলটা হস্তান্তর করবে।’

ইএআর/এমএএস/পিডি/সায়ীদ আলমগীর/এসএইচএস/এইচএ/জেআইএম